সুস্থ থাকার জন্য আমরা যে মাছ, মাংস, সবজি, ফল, দুধ কিংবা চা পান করছি, তা ক্রমে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা একের পর এক ভয়াবহ তথ্য উন্মোচন করছে মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, সবজি ও ফলে ভারী ধাতু, ব্রয়লার মুরগির শরীরে ট্যানারি বর্জ্যরে প্রভাব, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিক, এমনকি টি-ব্যাগেও সিসা, পারদ ও আর্সেনিক।
এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা আর অবহেলার জায়গা রাখে না। সমস্যার গভীরতা বোঝা কঠিন নয়। ভারী ধাতু ও মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে ঢুকে ক্যানসার, কিডনি জটিলতা, হৃদরোগ, প্রজনন সমস্যা থেকে শুরু করে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিতেও মারাত্মক প্রভাব। যেই টিব্যাগের চা আমরা প্রতিদিন পান করছি সেখানেও পাওয়া গেছে বিপজ্জনক ভারী ধাতু।
এনভায়রনমেন্ট ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এসডোর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গত ১৮ সেপ্টেম্বর। বাজার থেকে সংগ্রহ করা ১৩টি নমুনা পরীক্ষায় টি-ব্যাগের প্যাকেজিংয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতু পেয়েছে তারা। যেমন ক্রোমিয়াম সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯০ পিপিএম (নিরাপদ সীমা ৫ পিপিএম), সিসা ৫১ পিপিএম পর্যন্ত (সীমা ৫ পিপিএম), পারদ ১০৮ পিপিএম পর্যন্ত (সীমা ০.৩ পিপিএম), আর্সেনিক ১৪ পিপিএম (সীমা ২ পিপিএম)।
সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হলো এসব ক্ষতিকর উপাদানের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক দেখা না গেলেও ১০-১৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে। আজ যেটাকে আমরা অবহেলা করছি, তা আগামী দিনে জাতির কর্মক্ষমতা ও অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার ওপর সরাসরি আঘাত হানবে।
এত গুরুতর সংকটের মুখে সরকারি পদক্ষেপ এখনো খণ্ডিত ও সীমিত। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে দিলেও সরকারি কর্তৃপক্ষ এ সতর্কবার্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিচ্ছে না। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিএফএসএ এ গবেষণাগুলোকে প্রাথমিক বলে অজুহাত দেখালেও বাস্তবতা হলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইতোমধ্যেই দৈনন্দিন খাদ্য দ্রব্যে ক্ষতিকর উপাদানের স্পষ্ট প্রমাণ হাজির করেছে। এখন আর দেরি করার সুযোগ নেই।
গবেষণা দীর্ঘমেয়াদি বিষয় হলেও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া এখনই জরুরি। যেমন ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে ব্রয়লার খাদ্য তৈরি বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন, কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা, খাদ্যশিল্পে নিয়মিত পরিদর্শন ও নমুনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
খাদ্যনিরাপত্তা কোনো একক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়। স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সব সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নিয়ে যৌথ ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নাগরিক সচেতনতাও সমান জরুরি ভোক্তা পর্যায়ে সচেতনতা না এলে উৎপাদক ও ব্যবসায়ী মহলে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। এখন প্রশ্ন দেরি নয়, কাজ শুরু করার। আমাদের খাদ্য যদি আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে, তবে উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি কিংবা অর্থনৈতিক সাফল্যের কোনো মূল্যই থাকবে না। তাই খাদ্যদূষণের এ ভয়াবহ সংকট থেকে উত্তরণে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
কেকে/ এমএস