ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে কারসাজির অভিযোগে তোলপাড় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনে জাতীয় নির্বাচনের কয়েকমাস আগে ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনীতিতে চলছে নানা আলোচনা। এ নির্বাচন নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে তা যথার্থ ছিল না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও। অনেকে আশঙ্কা করছেন, জাতীয় নির্বাচনেও এরকম কারসাজি হতে পারে। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অরক্ষিতভাবে নীলক্ষেতে ছাপা হয়েছিল ডাকসু নির্বাচনে ব্যবহৃত ব্যালট পেপার। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, নীলক্ষেতে নয় বরং সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় উন্নতমানের ছাপাখানায় তৈরি হয়েছে ব্যালট। ঘটনার পরম্পরা আর সংশ্লিষ্টদের জবানবন্দি বলছে, নীলক্ষেতেই দায়সাড়াভাবে ছাপানো হয়েছে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট। এমনকি ছাপানোর সংখ্যা নিয়েও ছাপাখানা আর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যে রয়েছে ব্যাপক গরমিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাকসু নির্বাচনে কারসাজির অভিযোগ গুরুতর। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে শুধু ঢাবি প্রশাসন নয়, সরকারের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই সরকারের উচিৎ, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার দ্রুত সুরাহা করা।
অবশ্য ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে চলেছে পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ। প্রশাসন কারসাজির বিষয়ে কিছুই পাত্তাই দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে তা যথার্থ ছিল না। যেসব অনিয়ম বা অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসন সেসবের কিছুই পাত্তাই দেয়নি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুর-১-এ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা ও ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আসাদুজ্জামানের ষষ্ঠ স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন। রিজভী বলেন, ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে নীলক্ষেতে-এটা চাপা দেবেন কীভাবে? ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিরোধ নেই। তবে অসমতল মাঠে নির্বাচন দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের প্রতারিত করেছে প্রশাসন। কারও উদ্দেশ্য সাধনে একগুঁয়েভাবে নির্বাচন দেয়া হয়েছে বলেও তিনি প্রশ্ন রাখেন। তিনি আরও বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বসে একটি শ্রেণি অসৎ কাজ করে যাচ্ছে। তাদের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের নজর রাখা উচিত ছিল। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এর আগে ডাকসু ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির বিজয় লাভ করেছে। এ বিজয়ে অনেকেই অভিভূত হয়েছেন। এ নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে।
গত শনিবার রাজধানীর মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন আল-ফালাহ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দলটির কেন্দ্রীয় মহিলা বিভাগীয় মজলিশে শুরার অধিবেশনে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন। দলটির পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়ম-অসংগতি ও অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের উপপরিচালক ফররুখ মাহমুদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে প্রার্থীদের অভিযোগকে ‘অনির্দিষ্ট’ ও ‘সারবত্তাহীন’ বলে উল্লেখ করা হয়, যা নিয়ে ছাত্রদল তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রার্থীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ১১টি নির্দিষ্ট অভিযোগ এবং আবেদনপত্রের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই এই বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল কেন্দ্রের নির্দিষ্ট বুথের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনার জন্য প্রার্থীদের আবেদনকে প্রশাসন ‘অনির্দিষ্ট’ বলে অভিহিত করেছে।
ছাত্রদলের অভিযোগ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের নির্দিষ্ট বুথের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনার আবেদন থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেটিকে ‘অনির্দিষ্ট’ বলেছে। তারা আরও দাবি করেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তা সম্পূর্ণ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ছাড়া নিরসন সম্ভব নয়।
ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়নি, পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি যাচাইয়ের সুযোগ দেয়া হয়নি। এর ফলে প্রশাসনের দেয়া ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে আবেদন জানানো হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
এছাড়া, নীলক্ষেতে ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে, এমন অভিযোগও প্রশাসন অস্বীকার করেছে। কিন্তু সম্প্রতি একাধিক সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেছে ছাত্রদল। তাদের মতে, প্রশাসন এ নিয়ে মিথ্যাচার করছে।
তাদের দাবি, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে আবেদন করার পরও প্রশাসন ‘দুই সপ্তাহ পর অভিযোগ তোলা হয়েছে’ বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যোগ্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় অভিযোগগুলো তদন্ত করে শিক্ষার্থীদের সামনে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবে, এমন প্রত্যাশাই তাদের।
ডাকসু নির্বাচনে জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।
গতকাল শুক্রবার ঢাবি সাদা দলের এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ডাকসু নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির যে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। ওই প্রতিবেদনে যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে।
এছাড়া, ডাকসু নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের এই অভিযোগ ঢাবির গৌরবময় ঐতিহ্য এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সাদা দলের শিক্ষক নেতারা বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনে যেসব ক্ষেত্রে কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেসব বিষয়ে ঢাবি প্রশাসনকে অনতিবিলম্বে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। অভিযোগগুলোকে ভুল প্রমাণ করা সম্পূর্ণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব।
নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতি প্রমাণিত হলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে এতে আরও বলেন, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত করে পুনরায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আর তা না হলে এই নির্বাচনটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনের দুই দিন আগে অরক্ষিত অবস্থায় বিপুল ব্যালট পেপার থাকার অভিযোগ করে আসছেন ছাত্রদল সমর্থিত ভিপিপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। তার অভিযোগ, এ সংক্রান্ত অভিযোগ দিলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এমনকি জবাবও দেয়নি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন এই ছাত্রদল নেতা। গত বুধবার দুপুরে তিনি তার ভেরিফায়েড আইডিতে লেখেন, নীলক্ষেতে ব্যালট পেপারের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না, সত্য উন্মোচিত হবেই। স্বচ্ছতা আদায় করা আমাদের দায়িত্ব। সবকিছু খুব দ্রুতই স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। মিথ্যার শক্তিতে বিভ্রান্ত হবেন না।
এর আগেরদিন মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের কার্যালয়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভিযোগ জানাতে যান আবিদসহ ভিপিপ্রার্থী উমামা ফাতেমা, আব্দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী।
গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচনের দিনই ছাত্রদলসহ বেশ কয়েকটি প্যানেলের প্রার্থীরা নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলে। মঙ্গলবার দুপুরে এসব অভিযোগ নিয়ে তিনটি প্যানেলের পক্ষ থেকে উপাচার্যের কার্যালয়ে যান ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান, উমামা ফাতেমা ও আব্দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী। সাক্ষাৎ শেষে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান জানান, নীলক্ষেতের গাউছুল আজমের একটি ছাপাখানা থেকে অরক্ষিত অবস্থায় ব্যালট পাওয়া যায়। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এরআগে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অসঙ্গতি ও অনিয়মের ১১টি অভিযোগ উত্থাপন করেছে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেন তারা।
কেকে/এআর