গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুশি ক্যাম্পে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় লুট করা হয় বিভিন্ন অস্ত্র। যার বেশিরভাগই এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর এসব অস্ত্র ব্যবহার করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীরা। লুটের অস্ত্র ব্যবহার করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি পাশাপশি এবার পুলিশ ক্যাম্পেও হামলা ঘটনা ঘটেছে। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যদিও এসব অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত সোমবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে একটি পুলিশ ক্যাম্পে লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় একদল ডাকাত। এ সময় পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের ওপর নৌ ডাকাত দলের সদস্যরা গুলি ও ককটেল হামলা চালিয়েছে। আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে পুলিশও। উভয় পক্ষের মধ্যে শতাধিক গোলাগুলি হয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুর অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পসংলগ্ন মেঘনা নদীতে এ ঘটনা ঘটে। ডাকাতদলের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো থানা থেকে লুট করা বলে জানিয়েছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোমবার বিকেল পাঁচটার পরপর পাঁচ-ছয়টি দ্রুতগতির ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পসংলগ্ন মেঘনা নদীতে মহড়া শুরু করে নৌ ডাকাত নয়ন, পিয়াস ও রিপনের পক্ষের ৩০-৪০ জন সদস্য। এ সময় ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা ডাকাত দলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে নদীতে অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। পুলিশের প্রস্তুতির বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে ডাকাত দলের সদস্যরা চাঁদপুরের বেলতলীর দিকে গিয়ে আড়াল হয়ে যায়। কিছু সময় পর সোয়া পাঁচটার দিকে মাথায় হেলমেট পরে আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি, ককটেল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসে। ক্যাম্পে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে একের পর এক ককটেল ও গুলি ছুড়তে থাকে ডাকাত দলের সদস্যরা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। এ সময় ডাকাতদের পক্ষ থেকে প্রায় ১০০টি এবং পুলিশের পক্ষ থেকে ২০টির মতো গুলি ছোড়া হয়। আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলে। একপর্যায়ে পুলিশের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে ট্রলার নিয়ে মতলবের দিকে চলে যায় হামলাকারীরা।
ঘটনার সময় ওই পুলিশ ক্যাম্পে ছিলেন গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার আলম আজাদ। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌ ডাকাত নয়ন, পিয়াস, রিপনের নেতৃত্বে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত পাঁচ-ছয়টি ট্রলার নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করা হয়। হামলাকারীদের দলে ৪০ জনের ওপরে সদস্য ছিল। তারা দেশি-বিদেশি অস্ত্রসহ প্রস্তুতি নিয়ে হামলা করেছিল। তাদের হাতের অস্ত্রগুলো থানা থেকে লুট করা। তারা আমাদের লক্ষ্য করে শতাধিক গুলি করেছে। আমাদের দিক থেকে ১৯টির মতো গুলি করা হয়েছে। আমাদের কোনো পুলিশ সদস্য আহত হয়নি। তবে কোনো সন্ত্রাসী আহত হয়েছে কি না, তা আমরা বলতে পারব না।’
এদিকে গতকাল কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানিয়েছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ২ হাজার ৭০০-এর বেশি বন্দী পালিয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক বন্দী পলাতক আছেন। তিনি বলেন, পলাতকদের মধ্যে জঙ্গি আছেন ৯ জন। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আছেন ৬০ জন। তিনি বলেন, সে সময় লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৯টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনার পর গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় লুট করা অস্ত্র দিয়ে পুলিশ ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যৌথ বাহিনী।
লুটের অস্ত্রের ১৩৬৩টির হদিস নেই
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি, বক্সসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। এসব জায়গা থেকে ৫ হাজার ৭৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়। গোলাবারুদ লুট হয় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি। লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি (স্মল মেশিনগান), এলএমজি (লাইট মেশিনগান), পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, কাঁদানে গ্যাস লঞ্চার, কাঁদানে গ্যাসের শেল, কাঁদানে গ্যাসের স্প্রে, সাউন্ড গ্রেনেড ও বিভিন্ন বোরের গুলি।
লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, এই অভিযানে চলতি বছরের ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আর গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১১২টি। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত সময় (গত ২৮ জুলাই) পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংস্থাটির লুট হওয়া অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলো অপরাধীদের হাতে চলে গেছে, অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের সময় কারাগার থেকে পালানো সাত শতাধিক বন্দি এখনো ধরা পড়েননি। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছেন।
লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা: এলএমজি ৫ লাখ, শটগানে ৫০ হাজার
এদিকে গত সোমবার জুলাই-আগস্টে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তার ঘোষণা অনুযায়ী কেউ যদি একটি এলএমজির তথ্য দিতে পারেন তাকে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। উপদেষ্টা বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করে দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কেউ যদি একটা চায়না রাইফেলের সন্ধান দিতে পারে এবং সেটি উদ্ধার হয় তাহলে তথ্যদাতা ১ লাখ টাকা পাবে। এসএমজির ক্ষেত্রে দেড় লাখ, এলএমজির ক্ষেত্রে ৫ লাখ আর প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। কেউ যদি একটা গুলি এনে দেয় তাহলে সে ৫০০ টাকা পাবে। পিস্তলের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার, শটগানের তথ্য দিলে ৫০ হাজার টাকা পাবে। এসব তথ্য যারা দেবে তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে।
সার্বিক বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারসহ জেল পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো অভিযান চালাতে হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তা করতে হবে, তা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
কেকে/এআর