মাথায় হেলমেট। গায়ে পুলিশের দেওয়া বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। দুই হাত পেছনে, দুই হাতেই লাগানো হাতকড়া। দুই বাহু ধরে আছে দুই পুলিশ সদস্য। তাদের হাতের ওপর ভর দিয়েই ধীরপায়ে হেঁটে-হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় ওঠেন তিনি। সেখানেই ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মো. ছানাউল্লাহর আদালত। এ আদালতের কাঠগড়াতেই একটানা ৪০ মিনিট মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন ৮১ বছর বয়সি বৃদ্ধ। কাঠগড়ায় থাকাকালে পুলিশ খুলে দিয়েছিল একহাতের হাতকড়া। ঠিক যেভাবে উঠেছিলেন তিনতলায়, আদালতের কার্যশেষে সেভাবেই নিচে নামেন তিনি। আদালত কক্ষ ত্যাগের আগে নিজের দুই হাত নিজেই পেছনে দিয়ে দেন, যেন হাতকড়া পরিয়ে দেন পুলিশ। হয়েছেও তাই। পুরো সময়টাই চোখে-মুখে স্পষ্ট ছিল বিষণ্নতা, হতাশা, ক্লান্তি আর দুঃখবোধ।
যে দৃশ্যপটের কথা বর্ণিত হয়েছে এতক্ষণ, এটি ২৪ জুলাইয়ের ঘটনা। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি এবিএম খায়রুল হক। বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি। যিনি ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত বসেছিলেন বিচারকের সর্বোচ্চ এজলাসে। ওই পদে বসার আগে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি। ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। মেয়াদ শেষে কয়েক দফা পুনর্নিয়োগও পান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ১৩ আগস্ট আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পর থেকে থাকতেন ধানমণ্ডির বাসায়। সেখান থেকেই ২৪ জুলাই সকালে তাকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। সকালে গ্রেফতার হলেও তাকে আদালতে তোলা হয় সন্ধ্যারাতে। জনরোষ এড়াতেই আইনশৃঙলা বাহিনীর এই বিশেষ সতর্কব্যবস্থা। খায়রুল হকের বর্তমান ঠিকানা কারাগার। গ্রেফতারের আগে-পরে পৃথক চারটি মামলার আসামি হয়েছেন। এর মধ্যে একটি হত্যা মামলা।
এবিএম খায়রুল হকই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রধান বিচারপতি, যার হাতে উঠেছে হাতকড়া। যেতে হয়েছে কারাগারে। যাওয়ার আগে নিম্ন আদালতে থাকতে হয়েছে দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে। তার পক্ষে শুনানি করতে সেদিন আদালতে দাঁড়ায়নি এ দেশের কোনো সিনিয়র-জুনিয়র আইনজীবী।
বৃদ্ধ বয়সে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির এমন বিব্রতকর ও করুণ পরিণতির দৃশ্য নিশ্চিতভাবেই বিবেকবান মানুষের অস্বস্তি ও চক্ষু-যন্ত্রণার কারণ হওয়ার কথা। জোরালো প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সমাজ-সচেতন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। কিন্তু মিলেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রতিক্রিয়াকারীদের বড় অংশটিই আবার একপ্রকার স্বস্তিবোধ করছেন। প্রতিশোধ নিতে পারার তৃপ্তিবোধ ছিল কারো-কারো মধ্যে। প্রতিক্রিয়া দেখে স্পষ্ট, প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী ঘরানার আইনজীবীসহ অন্য অনেক পক্ষই খায়রুল হকের আরো করুণ পরিণতির প্রহর গুনছেন। একমাত্র আওয়ামী লীগপন্থি কয়েকজন আইনজীবীর ঘটনাপরবর্তী প্রতিক্রিয়া ছিল খায়রুল হকের পক্ষে। ১১ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে খায়রুল হক ইস্যুতে জাতীয়বাদী পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে হট্টগোলেও জড়িয়েছেন কয়েকজন আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবী। প্রতিবাদ বলতে এতটুকুই। তাও আবার গ্রেফতারের পনেরো দিনের মাথায়।
প্রশ্ন হচ্ছে এবিএম খায়রুল হকের মতো একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে কেনো এমন করুণ ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো হলো। কেনোই বা তাকে দাগী আসামির মতো দুই হাত পেছনে দিয়ে পরানো হলো হাতকড়া। তিনি কি আদালত চত্বর থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো ব্যক্তি কিংবা আসামি ছিলেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ দেশের বর্তমান সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বর্তমান বিচারব্যবস্থা কি এবিএএম খায়রুল হকের প্রতি অন্যায্য আচরণ করছেন কিংবা করেছেন। সব প্রশ্নের আইনি উত্তর পুরোপুরিভাবে আপাতত মিলবে না। অনেক উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে সময়ের। তবে শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর খায়রুল হকের জন্য পরণতি যেনো নির্ধারিতই ছিল। বরং অনেক আগের পরিবর্তে অনেক পরেই দৃশ্যমান হয়েছে পরিণতি। বিচারপতি পদে থাকার আগে-পরে তিনি যেসব কৃতকর্ম-অপকর্ম করেছেন, সেসবের নিদারুণ ফল ছিল অবশ্যম্ভাবী।
কী করেছিলেন খায়রুল হক, কেনো তাকে পলাতক শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র ও মাফিয়াতন্ত্রের প্রধানতম দোসর হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, কেন তাকে বিচারব্যবস্থা ধ্বংসের নায়ক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। কী কর্ম বা কী অপকর্ম ছিল খায়রুল হকের। উত্তরে যা মিলেছে, কারো কারো মতে তা তার বর্তমান পরিণতির বৈধতা এনে দিতে যথেষ্ট সহায়ক।
বিচারপতি থাকাকালে এবিএম খায়রুল হক যেসব রায় দিয়েছিলন, সেই রায়ের অনেক ছিল বিতর্কযুক্ত। কিছু রায়ের কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা স্বৈরতন্ত্র ও মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা পেয়েছেন খায়রুল হকের রায় থেকেই। অভিযোগ ছিল, প্রধান বিচারপতির মতো সাংবিধানিক একটি পদে বসেও দলদাসের মতো হাসিনার অনুগত হয়ে কাজ করেছেন খায়রুল। পরিণতিতে শেখ হাসিনার ১৬ বছরে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। পদে-পদে লাঞ্ছিত হয়েছে মানবতা, বিপন্নের পথে হেঁটেছে গণতন্ত্র।
খায়রুল হকের বিতর্কিত রায়গুলোর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেওয়া, স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম বাতিল এবং দুই বিতর্কিত বিচারপতিকে শপথ পড়ানো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এবিএম খায়রুল হকের রায়গুলোর মধ্যে সর্বাধিক বিতর্কিত রায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত রায়। তার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়। এ মামলায় বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক, বিচারপতি এস কে সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিঞা, নাজমুন আরা সুলতানা ও ইমান আলী রায় দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে। খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে কাস্টিং ভোট দেন। ফলে রায়টি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের চার-তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়। আপিল বিভাগে সাত বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রকাশ্যে দেওয়া রায়ের মূল অংশ ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে হবে।
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উন্মুক্ত আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশ পরে পাল্টে দেন তিনি। অবসর নেওয়ার ১৬ মাস পরে প্রকাশ করেন পূর্ণাঙ্গ রায়। আইনজ্ঞদের মতে, এটি শুধু খায়রুল হকের বিচারিক অসদাচরণই ছিল না, ছিল প্রতারণা ও এক প্রকার জালিয়াতি। খায়রুল হকের এ কর্মের কারণেই শেখ হাসিনা টানা তিনটি একতরফা নির্বাচন শেষ করার সুযোগ পেয়েছেন আদালতের দোহাই দিয়ে।
শেখ হাসিনাকে সুবিধা দিয়ে নিজে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগেও ইতোমধ্যে অভিযুক্ত খায়রুল হক। বিচারপতি থাকাকালে তার বেঞ্চে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক মামলা চলমান থাকা অবস্থায়ই তিনি স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২০০৯ সালের ২৭ জুলাই ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা আর্থিক অনুদান নিয়েছেন। যা বিচারিক নৈতিকতার পরিপন্থি হিসেবেই বিবেচিত। বিস্ময়কর হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় রায়ে খায়রুল হক উল্লেখ করেছিলেন, বিচারপতিরা অবসর নেওয়ার পর লাভজনক কোনো রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু নিজের দেওয়া রায় নিজেই মানেননি তিনি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে প্লট জালিয়াতির অভিযোগটি এরই মধ্যে মামলায় রূপ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগের পরও তিনি এই দেশের একজন মানুষ হিসেবে আইনি সুবিচার পাওয়ার অধিকার অবশ্যই রাখেন। সব অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিয়ে কোনো পক্ষেরই প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। প্রশ্ন ওঠে তখনই, আগে থেকে তার বিরুদ্বে প্রতারণা-জালিয়াতির দুটি মামলা থাকার পরেও পুরোনো ঘটনার একটি হত্যা মামলায় তাকে আসামি হিসেবে আদালতে হাজির করা হয়। যে মামলাটিতে তার সত্যিকার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কেকে/এএস