দেশজুড়ে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই প্রকাশ্যে কেউ না কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। মেট্রোপলিটনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। একইসঙ্গে প্রকাশ্যে মানুষকে পিটিয়ে, কুপিয়ে আহত করার ঘটনাও বেড়েই চলেছে। এসব প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডে সাধারণ মানুষকে নির্বিকার থাকতে দেখা যাচ্ছে। তারা নির্মম-বর্বরোচিত ঘটনাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশকর্মীদের দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অস্ত্রশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে। এমনকি ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে যাচ্ছে এসব অস্ত্র। যা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছে তারা। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই হিংস্র হয়ে উঠছে অপরাধীরা। জুলাই-আগস্টে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র নৃশংস কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এসব অস্ত্র উদ্ধারে তৎপর সরকার।
বাংলাদেশে অপরাধীদের বেপরোয়া এবং নৃশংস আচরণের পেছনে রাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে একটি অপরাধপ্রবণ সমাজের শিকড় আরো গভীরে যাবে বলে মনে করছেন তারা।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা জানান দেয়, প্রশাসনের দুর্বলতা ও নজরহীনতার কারণে সমাজে এর প্রভাব বেড়েছে। ফলে খুব সাবলীলভাবে দুর্বৃত্তরা মব সৃষ্টি করতে পারছে। এ ছাড়া সামাজিক অবক্ষয় এমন পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় এমন প্রকাশ্য নৃশংসতা সমাজে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ও অনিরাপত্তার ইঙ্গিত দেয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে নিজেদের হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই নৃশংসতার পথ বেছে নেয় অপরাধীরা।
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার কয়েকটি দোকান ও গুদামে গত শনিবার অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এসব অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ আর্মি ক্যাম্পে রাতেই এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের ডেয়ারিং টাইগার্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজিম।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজিম বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি এই আইটেমগুলো (ধারালো অস্ত্র) কোনো একটা জায়গা থেকে সন্ত্রাসীদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে, এমনকি ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। কিছু কিছু সময় ফ্রি ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে, হোম ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ঢাকার কোনো একটি জায়গা থেকে এই আইটেমগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে দেওয়া হয়। সন্ত্রাসীরা এ ধরনের দেশি অস্ত্রই বেশি ব্যবহার করে। গত তিন-চার মাস ধরে এগুলো বিশাল আকারে মজুত করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের হাতে দেখা যাচ্ছে।’
লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে তথ্য দিলে পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিন বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় গত বছরের ৫ আগস্টের আগে-পরে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তা উদ্ধারে সরকার শিগগিরই বিজ্ঞপ্তি দেবে। অস্ত্র উদ্ধারে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে সরকার পুরস্কার দেবে।
গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বেশিরভাগ আইনের আওতায় এসেছে। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সরকার তা করবে। যত দ্রুত সম্ভব চার্জশিট দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, ‘এ জাতি অসহিষ্ণু হয়ে গেছে। ধৈর্য নেই। আগে সমাজে খারাপ ঘটনা ঘটতে থাকলে লোকজন প্রতিহত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এখন জিনিসটি কমে গেছে। সবাই ভিডিও করছে। অথচ ঘটনা মোকাবিলায় মোবাইলটা ছুড়ে মারলেও কিছু একটা হয়। কিন্তু এ জিনিসটা কমে গেছে।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক বলেছেন, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকে। অপরাধ সংঘটনের পর তারা দ্রুত আসামি ধরতে সক্ষম হলেও অপরাধ ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নয়, অপরাধে নীরব দর্শক সরকার। গত শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নির্বাহীর মাসিক বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা
গণপিটুনিতে প্রাণ গেল জামাই-শ্বশুরের : রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে দুজন নিহত হয়েছেন। গত শনিবার রাতে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুরের রূপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫)। সম্পর্কে তারা ভাগনি জামাই ও শ্বশুর।
জানা গেছে, রূপলাল দাসের মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল মিঠাপুকুরের শ্যামপুর এলাকার লাল চাঁদ দাসের ছেলে ডিপজল দাসের সঙ্গে। রোববার (১০ আগস্ট) বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এজন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে রূপলাল দাসের বাড়ির দিকে রওনা হন ভাগনি জামাই প্রদীপ দাস। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দুজনকে মারধর করে।
পেকুয়ায় রাতে ঘরের ভেতরেই কুপিয়ে হত্যা : রাতের আহার সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ঘরের বাসিন্দারা। গভীর রাতে মুরগির খোপে শিয়াল ঢুকেছে ভেবে খোলা হয় ঘরের দরজা। মুহূর্তেই ৭-৮ জন ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘরের ভেতরেই কুপিয়ে হত্যা করেন এক ব্যক্তিকে। গত শনিবার রাতে এ ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারের পেকুয়ার শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়ার সেগুনবাগিচা এলাকায়। নিহত মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন (৪৫) তিনি উপজেলার মাঝেরঘোনা এলাকার নুর আহমদের ছেলে। এ হত্যার ঘটনাটিতে পুলিশ গতকাল সকালে দুজনকে আটক করেছে।
এদিকে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পাথর মেরে হত্যা, সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা, সৌরভের পা থেঁতলে দেওয়াসহ গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি নৃশংসতা হয়েছে। সৌরভ বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
তুহিনের হত্যার ঘটনায় আসামিদের শনাক্ত করার পর গ্রেফতার করা হয়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ক্রাইম-উত্তর) রবিউল হাসান ও বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, সৌরভের ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে।
৭ আগস্ট গাজীপুর মহানগরের মেট্রোপলিটন সদর থানার পাশে সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন সৌরভকে মারধর করা হয়। কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাকে হাত ধরে টেনে মাটিতে ফেলে মারধর করে। তাদের মধ্যে একজন ইট দিয়ে বারবার আঘাত করে সৌরভের পা থেঁতলে দেয়।
একই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে পাঁচ-ছয়জন দুর্বৃত্ত। এ সময় তিনি দৌড়ে ঈদগাঁ মার্কেটের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন। পরে দুর্বৃত্তরা তাকে দোকানের ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়।
এ দুই ঘটনার পর গত শুক্রবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর থেকে এক ব্যক্তির মাথাবিহীন ৮ খণ্ড লাশ মেলে। স্থানীয় একটি দোকানের পাশে পড়ে থাকা ট্রাভেল ব্যাগ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয় বলে জানান টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. ফরিদুল ইসলাম। গত ৬ আগস্ট রাজধানী বংশাল মালিটোলা এলাকায় হীরা নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনার পেছনে মাদক বেচাকেনা ও সেবনের বিষয় থাকতে পারে। হত্যার ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
তার আগে গত ৩ আগস্ট দিবাগত রাতে রাজধানীর দারুস সালাম থানার দক্ষিণ বিশিল এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে তাহমিনা রহমান রানু (৪২) নামে এক নারী নিহত হন। তিনি স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামের বোন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, এসব ঘটনা শুধু মানবজীবনের করুণ পরিণতি নয়, এটি দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হামলা। এটি প্রমাণ করে, দেশে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের দুঃসাহস কতটা বেড়ে গেছে এবং তারা আইন ও প্রশাসনের ভয় না করে প্রকাশ্যে অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মব ভায়েলেন্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা মব করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা প্রশংসিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়েছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে যদি রেহাই পাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে তারা আরো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত হয়। ফলে তারা আরো বড় অপরাধী হয়ে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি যখন নিজেকে নিরাপদ মনে করে না তখন সে অন্যের বিপদে সরাসরি এগিয়ে যায় না। এখানে ব্যক্তির নিরাপ্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অপরাধের প্রতিবাদ করলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়। তাই সবাই নিজে নিরাপদ থাকতে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করে। কারণ সেখানে যে কিছুটা নিরাপদ মনে করে।’
কেকে/ এমএস