বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫,
৬ ভাদ্র ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫
শিরোনাম: আবারো সংঘর্ষে ঢাকা-সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা      রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশের উপপরিদর্শক শেখ আফজালুল      গাজা সিটি দখলে অভিযান শুরু ইসরায়েলের, নিহত ৮১      গ্যাস সংকটে ঝুঁকিতে বিনিয়োগ-রফতানি      মনোনয়নপত্র জমাদানে উৎসবমুখর পরিবেশ      ভারতে আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান, অভিযোগ অস্বীকার নয়াদিল্লির      দেশি মাছের প্রজাতি রক্ষা করতে হবে: মৎস্য উপদেষ্টা      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
বৈষম্যের মূল কাঠামোতে এখনো পরিবর্তন ঘটেনি
মো. মনির হোসেন
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫, ৩:১৩ পিএম
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান ছিল এক নজিরবিহীন ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত যা বহু বছরের জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা এবং প্রতিবাদকে এক বিস্ফোরণে পরিণত করেছিল। এ অভ্যুত্থানে যারা রাস্তায় নেমেছিল, তারা চেয়েছিল একটি সমতাবাদী, গণতান্ত্রিক, ন্যায্য রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেই দিনটির পর এক বছর পেরিয়ে এসেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে এই অভ্যুত্থান কি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন এনে দিতে পেরেছে? নাকি সেই পুরনো বন্দোবস্তেই আটকে থাকছে বাংলাদেশ? নাকি আমরা শুধু ক্ষমতার মুখোশ বদলের সাক্ষী হয়েছি? 

হাসিনাশাহীর বুলেটে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সহস্র প্রাণের প্রতিদান তবে কী? 

গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরে এই প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতির সামনে যেমন বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলেছিল, তেমনি সেই সম্ভাবনাগুলো ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তা, হতাশা এবং অস্পষ্ট নেতৃত্বে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একটি শাসকচরিত্রের পতন হলেও রাষ্ট্রের গভীরে প্রোথিত অন্যায় ও বৈষম্যের মূল কাঠামোতে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। 

এই অভ্যুত্থান হয়েছিল জনতার নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভর করে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক অবদান খুব সীমিত ছিল। বরং, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘু, দলিত ও বিভিন্ন পেশাজীবীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই এই আন্দোলন দৃঢ়তা পায়। তাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, অভ্যুত্থানের পর একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য ও মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথ সুগম হবে। কিন্তু আজ, এক বছর পর, সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রবল সন্দেহ দেখা দিয়েছে। 

গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা উপদেষ্টামণ্ডলীর নীতিহীনতা ও দিকনির্দেশনার অভাব প্রকট হচ্ছে বলে মনে করছেন নাগরিকরা। তারা মনে করেন, যারা এই মুহূর্তে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নিয়েছেন, তারা অনেকেই প্রথাবিরোধী ও সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত হলেও বাস্তবে তাদের মধ্যে কোনো যৌথ রাজনৈতিক কল্পনা নেই। এই উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে কোনো স্পষ্ট আদর্শিক অভিমুখ বা নৈতিক রূপরেখা নেই বলেই জনগণের মধ্যে আস্থা গড়ে ওঠেনি। বরং এদের অবস্থান অনেক সময়ই দোদুল্যমান ও সুবিধাবাদী বলে মনে হচ্ছে। অভ্যুত্থানের প্রথমদিকে রাষ্ট্র সংস্কারের যে স্বপ্ন তুলে ধরা হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই পেছনে সরে গেছে। মানুষের বিশ্বাস ভেঙে পড়ছে তারা মনে করছেন, হয়তো এটিও ছিল আরেকটি ধোঁকা। 

অভ্যুত্থানের ঠিক পরপরই শ্রমজীবী মানুষের ওপর চালানো দমন-পীড়নের বিষয়টিকেও বিবেচনায় নিচ্ছেন নাগরিকেরা। আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ, যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এই পরিবর্তনের জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাই অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দাবির আন্দোলনে গুলি চালায়। চারজন শ্রমিকের মৃত্যু এবং বহুজনের গ্রেফতার মানুষের মনোবল ভেঙে দেয়। প্রশ্ন উঠেছে এই সরকার যদি পুরনো ব্যবস্থার পুলিশই ব্যবহার করে, তবে এর নৈতিক বৈধতা কোথায়? 

নারী অধিকার প্রশ্নেও রাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ উঠে আসে। অভ্যুত্থানের সময়কার প্রতিরোধে নারীদের ভূমিকাই ছিল অন্যতম অনুপ্রেরণা। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর ঘোষিত নারী সংস্কার কমিশন গঠনের উদ্যোগ ঘিরে শুরু হয় মৌলবাদী হামলা, হুমকি এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর প্রচার। এর বিপরীতে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল নিষ্ক্রিয় ও দুর্বল। এই নিষ্ক্রিয়তা আসলে রাষ্ট্রের এক ধরনের মৌন সম্মতির পরিচায়ক। একবিংশ শতকের বাংলাদেশে এমন রাষ্ট্র চাইনি, যেখানে নারী নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের তলানিতে পড়ে থাকে। 

অন্যদিকে, সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা জানান, অভ্যুত্থান তাদের জন্য তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনেনি। উত্তরাঞ্চল, উপকূল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিকদের আকাক্সক্ষা ধূলিস্যাৎ হয়েছে। আজও তারা নাগরিক অধিকার, ভূমির নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের ঢাকামুখী আধিপত্য আরো প্রগাঢ় হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। সংস্কারের নামে যে কেন্দ্রীয় কাঠামো নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তা তাদের চোখে একধরনের নব-উপনিবেশবাদের রূপ। 

রাষ্ট্র সংস্কারের কাগজ-কলমের পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্বকে সামনে নিয়ে আসছেন অনেক নাগরিক। ‘মানবিক নিরাপত্তা নীতি’, ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন রূপরেখা’, ‘সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রতিবেদন’ এসব শুধু অভিজাত বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। এইসব নীতিনির্ধারণে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই, মতামত নেই, আলোচনার সুযোগ নেই। ফলে এসব নীতি জনগণের জীবনে প্রভাব ফেলছে না, বরং এক ধরনের নিস্তরঙ্গ প্রশাসনিক ভাষায় চাপিয়ে দেওয়া আদেশে রূপ নিচ্ছে। 

সংস্কার যদি জনগণনির্ভর না হয়, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। জনগণের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা যদি প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে না থাকে, তবে রাষ্ট্র যন্ত্র যতই পাল্টানো হোক মানুষের জীবনে তেমন কোনো বাস্তব পরিবর্তন আসে না। এখনো সরকার যে পথে চলছে, তাতে করে একধরনের প্রশাসনিক টেকনোক্রেসির আধিপত্য গড়ে উঠছে, যেখানে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের চর্চা অনুপস্থিত। 

আজ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রশ্ন গুরুত্ব পাচ্ছে। এই অভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনের ডাক ছিল না এটি একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের আহ্বান ছিল। কিন্তু আজও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পুরনো আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক আচরণ এবং জনবিচ্ছিন্ন ভাষা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রশাসনিক পরিভাষা ও সংবিধান সংশোধনের খসড়ায় যে ‘আধুনিকতা’র ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা অনেক সময়েই সমাজের বাস্তব ও বহুমাত্রিক চরিত্রকে অস্বীকার করে। 

এক বছর আগে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা আজ অনিশ্চয়তায় ঘেরা। জনমনে ক্রমবর্ধমান সন্দেহ এই পরিবর্তন আসলে তাদের জীবনে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনবে কিনা। যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে, তবে জনগণ নতুন করে আর বিশ্বাস স্থাপন করবে না। এতে করে রাজনৈতিকভাবে সচেতন, জাগ্রত একটি প্রজন্ম গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হবে। 

তবু আশার কথা হলো, সময় ফুরিয়ে যায়নি। যদি এখন অন্তর্বর্তী সরকার তাদের উপদেষ্টা কাঠামোকে নতুনভাবে চিন্তা করে, আদর্শিক রূপরেখা ও দিকনির্দেশনা স্পষ্ট করে, এবং জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তবে এখনো এই অভ্যুত্থান অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন, রাজনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন এবং মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
 
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে জোর দেওয়া যেতে পারে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে নারী, শ্রমিক, সংখ্যালঘু, দলিত, প্রান্তিক ও বহুত্ববাদী শক্তিগুলোকে। এই জনগোষ্ঠীর আস্থা ফেরানো না গেলে, অভ্যুত্থান শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা হয়েই থাকবে তার কোনো সামাজিক রূপান্তর ঘটবে না। আর নয়া বন্দোবস্ত হয়ে উঠবে পুরনো শাসনের নতুন মুখমাত্র। 

এখন সময় এসেছে আত্মবিশ্লেষণের। এই এক বছরে আমরা কোথায় এলাম? কারা উপকৃত হলো, আর কারা আরও একবার হারালো সব? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজলে এবং ভুলগুলো থেকে শিক্ষা না নিলে, ইতিহাস হয়তো আমাদের খুব কঠিনভাবে মূল্যায়ন করবে। সহস্র শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের বারবার এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াটা একটা লজ্জাস্কর বাস্তবতা এনে দেবে। এখনো আমাদের হাতে সময় আছে সে বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসা। তবে সেই সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। 

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, খোলা কাগজ

কেকে/ এমএস
আরও সংবাদ   বিষয়:  বৈষম্য   মূল কাঠামো   পরিবর্তন   জুলাই গণঅভ্যুত্থান  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

আবারো সংঘর্ষে ঢাকা-সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা
রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশের উপপরিদর্শক শেখ আফজালুল
আশুলিয়ায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জুয়েল শিকদার গ্রেফতার
সাভারে ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যু, ডাক্তারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
মাগুরায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় কৃষক নিহত

সর্বাধিক পঠিত

স্যুটার মান্নান হত্যা মামলার আসামি জুয়েল আটক
গতি বাড়াতে সমন্বয় টিমের মাধ্যমে কাজ করতে চাই: সমাজকল্যাণ সচিব
১০ হাজার ইয়াবাসহ পুলিশ সদস্য আটক
নওগাঁয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালন
স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও সমাবেশ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close