ঢাকার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পাথর মেরে নৃশংসভাবে হত্যা করার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ ও সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী। অনেক জেলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে বিক্ষোভ-মিছিল করে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ আরো অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
শনিবার দিনভর দেশজুড়ে এ প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। এসব কর্মসূচিতে ‘হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে রাজপথ।
হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গতকাল হেফজতের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমানের সই করা বিবৃতিতে এ নিন্দা জানানো হয়। বিবৃতিতে নেতারা বলেন, চাঁদা না দেয়ায় পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে রাস্তায় দিনের আলোতে পাথর দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আগেও বলেছি, যেখানে সরকার ও প্রশাসন ব্যর্থ, সেখানেই দেশপ্রেমিক জনতা ও জুলাই বিপ্লবী ছাত্র-জনতা এগিয়ে আসবেন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতাকে আমরা রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার ছাত্রদল নেতা তারেক রহমান রবিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চকবাজার থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রবিন অস্ত্র মামলায় আদালতে বলেন, তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। একইসঙ্গে মাহমুদুল হাসান মহিন এবং টিটন গাজী নামের আরো দুই আসামিকে আদালত রিমান্ডে পাঠিয়েছেন।
অন্যদিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত মূল আসামিদের গ্রেফতার না করা এবং এজাহার থেকে তিন আসামির নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ এনে এটাকে ‘রহস্যজনক’ বলেছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্না।
শনিবার রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপির তিন সংগঠন-জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ ঘটনায় যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট এবং ভিডিও ফুটেজ ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, আশ্চর্যজনকভাবে তাদের মামলার প্রধান আসামি করা হয়নি। যারা প্রাণঘাতী আঘাতগুলো করেছে, তারা অদ্যাবধি গ্রেফতারও হয়নি। এর কারণ আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, মামলার এজহারে উল্লেখিত বাদীর মেয়ে গণমাধ্যমে বলেছেন, মামলার এজহারে খুনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তিনজন খুনিকে পুলিশ কৌশলে বাদ দিয়ে নিরাপরাধ তিনজনকে আসামি করেছে। ঘটনার ৬০ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও খুনের প্রমাণাদি হাতে থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি মূল আসামিদের গ্রেফতার করা গেল না। এটা একটি বিরাট প্রশ্ন ও রহস্য।
যদিও হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইন্স, রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) ও ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস) পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘শুধু মিটফোর্ড নয়, সারা দেশে সংঘটিত এ ধরনের সব ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে মিটফোর্ডের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। একটা সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না।’ উপদেষ্টা আরো জানান, গত বুধবার সন্ধ্যায় ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গতকাল (শুক্রবার) বিকেলে র্যাব অস্ত্রসহ আরো দুজনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়া এদিন রাতেই আরো একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি সাধারণ মানুষকে যে কোনো ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানান। উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত অ্যাকশন নিচ্ছে।
এ ছাড়া নৃশংসভাবে হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত পৈশাচিক ও ন্যক্কারজনক ঘটনাটির দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজকে আরো গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন। বিবৃতিতে এ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানিয়ে শোক জ্ঞাপন করেন বিএনপি মহাসচিব।
এ ঘটনায় সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ভয় ও সংকোচ উপেক্ষা করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
হত্যার মামলা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ঘটনার বিচারের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। শনিবার সকাল ১০টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া এক পোস্টে আসিফ নজরুল এ কথা জানিয়েছেন।
পোস্টে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এ পাশবিক হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২-এর ধারা ১০-এর অধীন দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড চাঁদাবাজির কারণে নয়, বরং ভাঙারির একটি দোকানের মালিকানা ও আয়-ব্যয় নিয়ে বিরোধের ফলাফল। শনিবার লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন এক ব্রিফিংয়ে বলেন, দোকানের দখল ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বই এ হত্যার মূল কারণ। এখনো পর্যন্ত চাঁদাবাজির কোনো প্রমাণ মেলেনি। তিনি জানান, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পাঁচ সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। মামলার ১ নম্বর আসামি মাহিনসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ডিসি জসীম উদ্দিন যোগ করেন, প্রাথমিকভাবে এটি একটি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। তবে অন্য কোনো প্ররোচনা বা রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে কোনো পক্ষপাত করা হবে না।
উল্লেখ্য, ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ফেসবুক ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। নিহতের বোন কোতোয়ালি থানায় হত্যার মামলা করেছেন। এতে ১৯ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে এবং ১০-১৫ অজ্ঞাত ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, হত্যাকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে সোহাগকে টার্গেট করেছিল। আটককৃতদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
কেকে/ এমএস