গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকায় বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফেনী শহরের ভেতরেও পানি উঠেছে। অন্য এলাকার অলিগলি সব পানিতে ডুবে গেছে। এদিকে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। নোয়াখালীতে বৃষ্টির দাপটে আতঙ্কে পানিবন্দি মানুষ। টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রাজবাড়ী জেলার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিতে তলিয়ে আছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার কয়েকটি গ্রাম, লংগদুর সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
ফেনী: ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে বছর না পেরোতে ফের বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে ডুবছে একের পর এক জনপদ। এতে বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট তলিয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে বানভাসিদের উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি। ফেনীস্থ সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানায়, বন্যার্ত এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য স্পিডবোট নিয়ে আসা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বন্যাকবলিত পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ সতর এলাকার বাসিন্দা রবিউল হাসান বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করে ঘরবাড়িসহ সবকিছু তলিয়ে যাচ্ছে। গেল বছরের বন্যায় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। দেশে ক্ষমতা আর সরকারের পরিবর্তন হলেও আমাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না। নজরুল ইসলাম নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, সড়কে পানি থাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্কেও সমস্যা। এখনো শুকনো খাবার বা কোনো ধরনের প্রশাসনিক সহায়তা পাইনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের কারণে প্রতিবছর এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গেল বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই আবারো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা চার দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৬৩ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবারও জেলাজুড়ে হালকা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, দুপুর ১টার দিকে নদীর পানি বিপৎসীমার ২ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীতে পানি কমলেও ভাঙন স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি কমার পরেই বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে সেনাবাহিনী
বিজিবির ফেনী ব্যাটালিয়ন (৪ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, বিজিবি সদস্যরা আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার ও উদ্ধার কাজ করছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় গতকাল থেকেই আমরা কাজ করছি।
এ ব্যাপারে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার আংশিক অংশে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করছে। জেলার ছয় উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
নোয়াখালী: দিনের শুরুতে আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালীতে আবারো শুরু হয়েছে বৃষ্টি। এতে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে। গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এরপর বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে জনমনে। তারপর সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৯৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৯টা পর্যন্ত জেলায় উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মানুষজন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশায় ছিলেন। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফের বৃষ্টি শুরু হলে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া ও পানিবন্দি মানুষদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়।
জানা গেছে, নোয়াখালী সদর, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচরের বিভিন্ন অঞ্চলের নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জেলা শহর মাইজদীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মৎস্য অফিস, জেলখানা সড়ক, পাঁচ রাস্তার মোড়, পৌর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলো তলিয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এখনো অনেক এলাকায় কার্যকর না হওয়ায় ঘরবাড়ি ও সড়কে পানি জমে আছে। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কর্মজীবী মানুষ এবং যানবাহনের চালকদের। জেলা শহরের বাসিন্দা হৃদয় পাল বলেন, এভাবে যদি টানা বৃষ্টি শুরু হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। কেননা বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জলাবদ্ধতা থেকে স্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মো. শওকত আলী নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, বৃষ্টি আসলেই আমাদের আতঙ্ক বেড়ে যায়। বেশ কয়েকদিন আমরা টানা বৃষ্টিতে নিমজ্জিত। এতে করে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কোথাও কোথাও অপরিকল্পিত ড্রেন যার কোনো আউট লাইন নাই। উল্টো ড্রেন দিয়ে সড়কে পানি প্রবেশ করছে।
অশ্বদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শিউলি বেগম বলেন, আমাদের বাড়িতে পানি ঢুকে রান্নাঘর ডুবে গেছে আজ তিন দিন। স্বামীর কাজকর্ম নাই। কিন্তু এনজিওগুলো কিস্তি দেওয়ার জন্য বাসায় আসছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ শামীম বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি বেড়েছে। আমরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য কাজ করছি। এ ছাড়া পানিবন্দি পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
রাজবাড়ী: টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রাজবাড়ী জেলার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনো বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এম এ শামীম। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা নদীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পয়েন্টে পানি ৬ দশমিক ১৩ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টে পানির বিদৎসীমা ৮ দশমিক ২০ মিটার। পদ্মা ও হড়াই নদীর মহেন্দ্রপুর পয়েন্ট পানি ৬ দশমিক ৪৮ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্ট পানি বিদৎসীমা ১০ দশমিক ৫০ মিটার। পাংশার সেনগ্রাম পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ৭ দশমিক ১৮ মিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজবাড়ী জেলায় গত এক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও গত বুধবার থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
বুধবার রাতেও থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আবারো শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এম এ শামীম বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে রাজবাড়ী সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই। পানি বিপৎসীমার অনেক নিচেই রয়েছে। মানুষের পানিবন্দি হবার এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বৃষ্টিতে কিছু এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। আমারা পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে তৎপর আছি।
খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম এখনো টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। মাইনী নদীর পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় ছোট মেরুং বাজার এলাকা, সোবহানপুর, চিটাগাং পাড়া, কবাখালীসহ আশপাশের গ্রামগুলো এখনো প্লাবিত অবস্থায় রয়েছে। বন্যার কারণে দীঘিনালা-লংগদু সড়কের স্টিলব্রিজ এলাকায় সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গত দুই দিন ধরে রাঙামাটির লংগদুর সাথে দীঘিনালার সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা।
বন্যাকবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়ের জন্য ছোট মেরুং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে ৩৪টি পরিবার এখানে অবস্থান করছেন। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করেছে দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসন। ছোট মেরুং বাজার এলাকার বাসিন্দা জয়নব বেগম জানান, হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় তিনি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তার বসতঘরটি পানির তোরে ভেঙে গেছে। কীভাবে নতুন করে ঘর তুলবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা জয়নব বিবি বলেন, বন্যার পানিতে তার গৃহপালিত ছাগল ও হাঁস-মুরগির বড় ক্ষতি হয়েছে। ইতিমধ্যেই দুটি ছাগল ও অনেকগুলো মুরগির বাচ্চা পানিতে মারা গেছে। দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সুজন চন্দ্র রায় বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
শরীয়তপুর: শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিকান্দি এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভাঙন ঠেকাতে দুদিন ধরে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো। সেখানে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে অন্তত ৭০০ পরিবার। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে শতাধিক শ্রমিক ও দুটি বার্জ দিয়ে ভাঙনকবলিত এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কাজ চলছে। এর ফলে রাত থেকে নতুন করে আর কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি ভাঙনের কবলে পড়েনি বলে পাউবো জানিয়েছে।
স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পদ্মা নদীতে বিলীন হবে এলাকার রাস্তাাঘাট, হাট-বাজারসহ শতাধিক বসতবাড়ি। জাজিরা উপজেলার আলম খাঁর কান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সি কান্দি ও ওছিম উদ্দিন মুন্সি কান্দি গ্রামের অন্তত ৭০০ পরিবার এখন ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন। ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে এক হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে। যদিও তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।