# ২০৫০ সালের মধ্যে সবুজ, স্থিতিস্থাপক ও আঞ্চলিক হাব হবে বাংলাদেশ
# বিদ্যুৎ খাতে প্রকৌশলীদের আরো উদ্ভাবনী হওয়ার আহ্বান পিডিবি চেয়ারম্যানের
বাংলাদেশ সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য টেকসই অবকাঠামো এবং কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যার লক্ষ্য ২০৫০ সালের মধ্যে দেশকে একটি সবুজ, স্থিতিস্থাপক এবং আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করা। এ পরিকল্পনায় ২০৩১ সালের মধ্যে বিদ্যুতায়ন, ২০৪৬ সালের মধ্যে প্রায়-নেট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা অর্জনের সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন এ কর্মপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর ব্যাপক জোর দেওয়া হয়েছে, যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ভবনের মুক্তি হলে সম্প্রতি বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী সমিতির উদ্যেগে বিদ্যুৎ খাতে ‘টেকসই অবকাঠামো এবং কৌশলগত পরিকল্পনা : ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে প্রকৌশলীদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিউবোর সদস্য প্রশাসন (যুগ্মসচিব) মো. আমিনুল হক, সদস্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকৌশলী মো. শামসুল আলম, সদস্য উৎপাদন প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম এবং সদস্য কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স ও সদস্য বিতরণ প্রকৌশলী আ. ন. ম. ওবায়দুল্লাহ।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী সমিতি সাধারণ সম্পাদক প্রকৌ. মো. শাহেদুল আজিম (সজল)। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ প্রকৌশলী সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান। অনুষ্ঠানে বিউবোতে কর্মরত প্রকৌশলী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মূল প্রবন্ধে প্রকৌশলী মো. শাহেদুল আজিম বলেন, ‘প্ল্যাটিনাম জুবিলি’ ২০৪৬ রূপকল্পের মূল প্রতিশ্রুতি হলো— দেশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জন এবং আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যে নেতৃত্বদান।
তিনি বলেন, প্ল্যাটিনাম জুবিলি ২০৪৬-কে ঘিরে ঘোষিত রূপরেখার মূল স্তম্ভ চারটি কৌশলগত দিককে কেন্দ্র করে গঠিত। প্রথমত, স্থিতিস্থাপক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গঠন—যার লক্ষ্য হলো উদ্ভাবন, সুসংহত নীতিমালা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি আধুনিক, কার্যকর ও টেকসই শক্তি অবকাঠামো গড়ে তোলা। এ ব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হবে, যাতে তা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সহ্য করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয়ত, প্রায়-নেট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ— এ রূপরেখার অন্যতম অঙ্গীকার হলো ২০৪৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনে প্রায়-নেট-শূন্য কার্বন নির্গমন অর্জন। এ লক্ষ্য পূরণে ধাপে ধাপে জ্বালানি ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটানো হবে।
তৃতীয়ত, আঞ্চলিক বিদ্যুৎ হাব হিসেবে আবির্ভাব—বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার পরিচ্ছন্ন জ্বালানি বাণিজ্যে নেতৃত্বদানকারী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময়ের সুযোগ বাড়িয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি আরো শক্তিশালী করার দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
চতুর্থত, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ—জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় শক্তিশালী, টেকসই এবং অভিযোজনক্ষম অবকাঠামো নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য এবং টেকসই শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিদ্যুৎ খাতে টেকসই অবকাঠামো এবং কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রকৌশলীদের আরো সক্রিয় ও উদ্ভাবনী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে কেবল আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করলেই হবে না, প্রকৌশলীদেরও দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, দক্ষ জনশক্তির অভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে এখনো বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করতে হয়। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে নিজস্ব প্রকৌশলীরা কাজ করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
রেজাউল করিম বলেন, বিদেশি একটি তরিকা দিয়েছে সেটা আমরা অনুসরণ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে আমরা একটা দুর্বল খাতে পরিণত করেছি। এগুলো আমাদের উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে। আমরা আত্ম-উন্নয়ন হব, যদি কর্মদক্ষতায় সেই ইন্ডিকেটর পর্যন্ত আসতে পারেন, তখনই আপনাকে মূল্যায়িত করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ সমন্বিত কৌশলগত পরিকল্পনা বাংলাদেশকে শুধু শক্তি খাতে আত্মনির্ভরশীল করবেই না, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ লক্ষ্য অর্জনে মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির স্থানান্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকার আশা করছে, এ রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ুসংকটে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে একটি উদাহরণমূলক পরিবেশবান্ধব ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
বিদ্যুৎ খাতের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ পরিকল্পনা কেবল কারিগরি উন্নয়নে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং মানবসম্পদ উন্নয়ন, কার্যকর নীতি প্রণয়ন এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধতাকে কেন্দ্রে রেখে এগিয়ে যাবে। ঐতিহ্যবাহী প্রকৌশল পদ্ধতির পরিবর্তে টেকসই প্রকৌশল পদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে। ২০৪৬ সালকে ‘প্ল্যাটিনাম জুবিলি’ হিসেবে উদযাপন করে সবুজ জ্বালানি সার্বভৌমত্ব অর্জনের পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যে আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাও এ পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
কেকে/এজে