দুনিয়ায় রেলের ইতিহাস শুরু হয়েছিল বহু আগেই, ১৮২৫ সালে। ইংল্যান্ডের এক প্রকৌশলী জর্জ স্টিফেনসন ‘লোকোমোশন’ নামে প্রথম স্টিম ইঞ্জিনচালিত ট্রেন বানিয়েছিলেন। ২৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্টকটন থেকে ডালিংটন পর্যন্ত ছুটেছিল সেই ট্রেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে রেলগাড়ি।
ছবি : সংগৃহীত
সেই সময় ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের অধীন। ব্যবসা, শাসন ও পণ্যের চলাচল সহজ করতে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় উপমহাদেশে রেললাইন বসানোর। ১৮৫৩ সালে মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে থানে পর্যন্ত চালু হয় প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন। এক বছর পর রেল চলাচল শুরু হয় বাংলা অঞ্চলেও। পশ্চিমবাংলার হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ছিল সেই রেলপথ।
ছবি : সংগৃহীত
তারপর ১৮৬২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে চালু করে শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেললাইন। সেটি বাড়িয়ে আনা হয় আজকের কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর, ঐতিহাসিক সেই দিনে আজকের বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পড়ে প্রথম রেলগাড়ি। কলকাতার শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা ট্রেনের গন্তব্য ছিল কুষ্টিয়ার ‘জগতি রেলস্টেশন’। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তৎকালীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রেলের যাত্রা। যা পরে যোগাযোগব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। তাই বলা হয়—কুষ্টিয়ার জগতি রেল স্টেশন বাংলাদেশের প্রথম রেল স্টেশন।
ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের রেলওয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জগতি রেলস্টেশনের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এ রেলস্টেশনটি কেবল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা করেনি, বরং এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের পথও খুলে যায়।
১৮৭১ সালে জগতি থেকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নতুন রেললাইন চালু হয়। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার সহজতম এই পথে রেলপথ সংযোগ চালু করা ছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তখন শিয়ালদহ থেকে ট্রেন আসত জগতি পেরিয়ে গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে। এরপর স্টিমারে পদ্মা পার হয়ে যাত্রীরা সহজেই চলে আসতেন ঢাকায়।
ছবি : সংগৃহীত
সেই সময়ে রেলের ইঞ্জিন চলত কয়লা পুড়িয়ে। ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে হুইসেল দিতে দিতে ট্রেন ঢুকত স্টেশনে। ব্রিটিশরা জগতিতে তৈরি করেছিল লাল ইটের দোতলা স্টেশন ভবন, ওয়েটিং রুম, পানির ট্যাংক, টিকিট ঘর, সিগন্যাল ল্যাম্প। কুষ্টিয়ার জগতিতে কেন প্রথম রেলস্টেশন
এখন জগতি স্টেশন যেন পড়ে আছে ইতিহাসের খাতার বাতিল পৃষ্ঠা হয়ে। চারপাশে নিঃশব্দ, প্ল্যাটফর্ম ভাঙা, ভবনে ফাটল। আর আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ভগ্নপ্রায় সেই স্টেশন ভবনে। কুলির হাঁকডাকও নেই। নেই ট্রেনের হুইসেল। রাত নামলেই যেন এক ভুতুড়ে জায়গা।
ছবি : সংগৃহীত
প্রথম রেলস্টেশন কেন জগতিতেই? সেই রহস্য লুকিয়ে আছে ব্রিটিশ আমলের হিসাব-নিকাশে। পুরো ভারতবর্ষকে ব্যবসা ও শাসনের সুবিধার্থে জালের মতো রেললাইন দিয়ে জুড়েছিল ব্রিটিশরা। তখন তারা খুঁজছিল এমন এমন জায়গা, যেখানে নতুন রেললাইন বসালে বছর শেষে তাদের লাভের অঙ্ক বাড়বে। জগতির কাছাকাছি ছিল কলকাতার রানাঘাট রেলপথ। তাই সেখানে নতুন বড় কোনো প্রকল্প ছাড়াই বর্ধিত অংশ হিসেবে কম খরচে জগতি পর্যন্ত রেলপথ আনা যায়। এই বুদ্ধিই তারা কাজে লাগিয়েছিল। তবে শুধু ভৌগোলিক কারণেই নয়। বাণিজ্যের দিক থেকেও সেই সময়ের কুষ্টিয়া অঞ্চল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মার আশপাশে ছিল ধান, পাট, গম, আখের জমি। এখান থেকে পণ্য কলকাতা বা ঢাকায় পাঠানো ছিল ব্রিটিশ বাণিজ্যের প্রধান লক্ষ্য।
ছবি : সংগৃহীত
এই রেলপথের সুফল হিসেবে ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়ায় গড়ে ওঠে তখনকার এশিয়ার সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল মিল- মোহিনী মিল। ট্রেন ছাড়া এত বড় মিলের কাঁচামাল আনা বা পণ্য পাঠানো সম্ভবই হতো না। পাকিস্তান আমলেও কুষ্টিয়ায় তৈরি হয় চিনিকল। যেখানে আখ পৌঁছাত এই রেলপথ দিয়েই।
ছবি : সংগৃহীত
১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতার রাণাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ চালু হয়। এ রেলপথটি চালু হওয়ার পর এ অঞ্চলে রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ সম্প্রসারণ করা হয়। এক সময়ে যাত্রীদের কোলাহলে মুখরিত থাকত এ স্টেশনটি। তবে কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা ও উদাসীনতায় রেলওয়ে বিভাগ ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বারবার আশ্বাস দিলেও কোনো কাজ হয়নি।
ছবি : সংগৃহীত
সরেজমিন দেখা যায়, জগতি রেল স্টেশনটি যেন এক ভুতের আড্ডা। স্টেশন মাস্টার তো দূরের কথা সেখানে গার্ড কিংবা টিকিট কাউন্টারও নেই। নেই যাত্রীদের বসার কোনো স্থান। প্ল্যাটফর্মে জন্মেছে গাছ ও লতাপাতা। অফিস রুমে নেই কোনো জানালা, দরজা থাকলেও তালা দেওয়া। রয়েছে ট্রেনের সিডিউল বোর্ড যা সর্বশেষ ২০০৯ সালের। দ্বিতল ভবনের অফিসের ছাদ থেকে কংক্রিটের সঙ্গে খসে পড়েছে লোহাও। দেয়ালের চারিদিকে ধরেছে ফাটল। কক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে সূর্যের আলো। প্রথমতলায় প্রায় সব কিছু লুটপাট হয়েছে। দ্বিতীয়তলার জানালা থেকে বের হওয়া বটগাছ ও আগাছাগুলো বলে দেয় এর অবহেলার চিত্র। একসময় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের পানি নেওয়ার জন্য জগতির যে দীঘি ও পানির ট্যাংক ব্যবহার হতো সেই দীঘি ও ট্যাংকগুলোর অবস্থা আরও নাজুক।
ছবি : সংগৃহীত
বয়সের ভারে ন্যুব্জ ভগ্নপ্রায় ‘জগতি রেলস্টেশন’-এর লাল ইটের তৈরি দ্বিতল ভবনটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লাল ইটের দালান এখন মলিন। আশপাশ শ্যাওলা, ময়লা জীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। ভবনে ফাটল ধরায় উপরতলাতে কেউ যায়নি বহু বছর। অনেক দিন আগে যাত্রীদের সুবিধার জন্য তৈরি করা ওয়েটিং রুমও ভেঙে গেছে। প্ল্যাটফর্মের ইটও ভেঙে গেছে। ক্ষয়ে গেছে গাঁথুনিও। কক্ষের ভেতরের যন্ত্রাংশ সবই বিকল। এগুলোর কোনো ব্যবহার ও সংস্কার কিছুই নেই।
ছবি : সংগৃহীত
ব্রিটিশরা ওই সময় সরকারি স্থাপনাগুলোতে লাল রং ব্যবহার করত। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ব্রিটিশরা চলে গেছে বহু আগে, পাকিস্তানিরাও। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সময়েও এ রঙের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এমন অনেক ভবন বাংলাদেশ-ভারতে দেখা যায় যেগুলোতে আজও লাল রং বিদ্যমান।
পরে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করতে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি জগতি স্টেশন থেকে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পদ্মা তীরবর্তী গোয়ালন্দঘাট পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়।