আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জাতীয় পার্টি। পার্টির কাউন্সিল ও নেতৃত্বের কোন্দল মাথাচাড়া দেওয়াতে আবারো ভাঙনের মুখে পড়েছে জাপা। ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পেতে মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে পার্টির প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর রাজনীতির মাঠে বেকায়দায় থাকা কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজন নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে জাপা। চেয়ারম্যানের একক কর্তৃত্ব নিয়ে দলের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে সরানোর জন্য একটি অংশ তৎপর হয়ে ওঠে। এটিকে সামাল দিতেই দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগের আমলে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ ভূমিকার কারণে দলটি সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলের বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানো ছাড়া জাপাকে সরকার এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর চাপ থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
দলীয় নেতারা বলছেন, জি এম কাদের সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে সরকারের সমালোচনা করছেন, তাতে আগামী নির্বাচনে জাপার পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব। সরকার এবং রাজনীতি কোথাও নেই জাপা। তাই জি এম কাদেরকে সরিয়ে নতুন নেতৃত্বের অধীনে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্কের মাধ্যমে নির্বাচনে জাপাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
সম্প্রতি দলের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতাকে অব্যাহতি দিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কদের। তবে তার এ সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি ও স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির অব্যাহতি পাওয়া নেতারা। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মো. মুজিবুল হক (চুন্নু) বলেছেন, জিএম কাদের সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে দলের নেতাদের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তারা জিএম কাদেরের সিদ্ধান্ত মানেন না। তারা দলের কাউন্সিলে অংশ নেবেন।
সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মুজিবুল হককে গত সোমবার দলীয় সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেন জাপা চেয়ারম্যান। ওইদিন বিকালে জাপার কেন্দ্রীয় দফতর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। অন্যদিকে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে দলের মহাসচিব করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে মোট ১১ জন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। এ নিয়ে জাপায় অস্থিরতা চলছে।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জি এম কাদের যে সভা ডেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, এই সভা তিনি ডাকতে পারেন না। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভা ডাকতে পারেন দলের মহাসচিব। তাই তাদের বিরুদ্ধে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা তারা মানেন না। তারা তাদের পদে বহাল আছেন।
জাপার গঠনতন্ত্রের যে ধারা বলে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তা বাতিলের দাবি জানান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এমন স্বৈরাচারী ধারা থাকতে পারে না। এর মাধ্যমে চেয়ারম্যান একাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, দলে যে কাউকে যুক্ত করা ও বহিষ্কার করার ক্ষেত্রে। এটি বাতিল করতে হবে।
এইচ এম এরশাদ অসুস্থ থাকা অবস্থায় তার কাছ থেকে জোর করে দলের কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব জি এম কাদের নেন বলে অভিযোগ করেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘জি এম কাদেরের প্রতিটি বিষয়ে স্বৈরাচারী মনোভাব।’
মুজিবুল হক বলেন, ‘আমরা জাতীয় পার্টি ছাড়ব না। আমরা জাতীয় পার্টি ভাঙতে দেব না। আমাদের অবদান দলের জন্য সবচেয়ে বেশি। আমরা কাউন্সিলে যাব, সেখানে আমাদের কথা গ্রহণ না করলে এরপর আর কথা থাকবে না।’
রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, তিনি ১৭ বছর জাপার মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে তাদের দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জি এম কাদের দলের ক্ষতি করছেন। তিনি যা করছেন, তা কোনো সুস্থ রাজনীতিবিদ করতে পারেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের ‘পাপ’ থেকে দলকে মুক্ত করতে এরশাদের ভাই জিএম কাদেরকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে পার্টির বড় একটি অংশ। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার এ অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ নিয়ে দল আরেক দফা ভাঙলে অবাক হবার কিছু নেই।
জাতীয় পার্টির দফতর থেকে জানানো হয়, দলের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে মুজিবুল হক চুন্নুকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার জায়গায় মহাসচিব করা হয়েছে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে। সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা ছিলেন।
গত ২৮ জুন দলের জাতীয় সম্মেলন ঘোষণা দিয়েছিলেন জিএম কাদের। এর মধ্যেই জাপায় নতুন নেতৃত্ব গড়ার উদ্যোগ নেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশিরভাগ সদস্য। বিশেষ করে কাউন্সিলে চেয়ারম্যান হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদপ্রত্যাশী বলে জানালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে জিএম কাদেরের কপালে।
বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও। এ পরিস্থিতিতে ভেন্যু জটিলতার কথা বলে ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত করেন জিএম কাদের।
সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবার ভাঙনের মুখে পড়ে। এর মধ্যে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। দ্বিতীয় দফার ভাঙন হয় ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে।
কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মতো ভাঙন ধরে। ২০১৯ সালে এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়। এবারো জিএম কাদের সম্মেলন ডাকতে গড়িমসি করলে সপ্তমবারের মতো দল ভাঙনের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলের গঠনতন্ত্রের ২০(ক) ধারা অনুযায়ী জাপা চেয়ারম্যান কারণ দর্শানো ছাড়াই দলের যে কাউকে পদ থেকে সরাতে পারেন, বহিষ্কার করতে পারেন। যে কাউকে যে কোনো পদ দিতে পারেন। এ জন্য তাকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। এ ধারাকে ‘অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী’ বলছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তাদের মতে এটি একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র। তারা বলেন, ‘আমরা পার্টি থেকে সেটা সরাতে চাই।
পার্টিতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কথা বলে তো লাভ নাই।’ যে কারণে দলের বর্তমান কমিটির সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশ বর্তমান চেয়ারম্যানকে এ ধারা সংশোধন করার অনুরোধ করেন। দলের বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও এই বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে শেষ পর্যন্ত মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনলেন জিএম কাদের।
কেকে/ এমএস