গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত হওয়া নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও একতরফা নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলতে থাকে সাধারণ মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটতে থাকে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এরই ধারাবাহিকতায় অতিসম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় ‘জনগণের ভোট ছাড়াই’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল হোতা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাকে আটক করে জনতা। ওই সময় উত্তেজিত জনতা তার বাসায় ঢুকে তাকে শারীরিক হেনস্তা করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, এক ব্যক্তি তার কলার ধরে বিগত নির্বাচনে তার ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যদিও এ ঘটনায় নানামুখী প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কেউ বলছেন, এটি জনতার দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। আবার কেউ বলছেন, এটি বিচারবহির্ভূত ‘মব অ্যাকশন’। এই প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। যেখানে বলা হয় ‘আইনের বাইরে গিয়ে কেউ বিচার করতে পারে না। দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তবে অনেক বিশ্লেষক, রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো সরাসরি মব অ্যাকশন নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা অসন্তোষের বিস্ফোরণ।
যদিও এসব ঘটনায় দেশে এখন ‘মবের মুল্লুক’ চলছে বলে মন্তব্য করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। গণমাধ্যমের কাছে তিনি এ মন্তব্য করেন। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, এখানে তো সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারা মব করেছে, তাদের তো ছবি আছে। ভিডিওতে তাদের তো দেখা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া যায়। খালি সরকার বিবৃতি দিলে তো কাজ হবে না। তিনি আরো বলেন, আসলে সরকার ব্যবস্থা না নিলে এই ধরনের মব ভায়োলেন্স বন্ধ হবে না। মব সন্ত্রাস তো একটা ক্রাইম।
এদিকে ‘সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলেই জনরোষ তৈরি হয়েছে। সরকার যদি আগেই তাদের গ্রেফতার করত তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। সম্প্রতি এক টকশোতে সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে গ্রেফতারের ঘটনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ এই মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেন, সিইসি যারা আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনকে নষ্ট করেছে তাদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া উচিত।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, মব এবং জনরোষের মধ্যে পার্থক্য আছে। কোনো অন্যায়ের জন্য কোনো ব্যক্তি নিজস্ব স্বার্থে যদি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নাই এরকম একটা বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে সেটা হচ্ছে মব। যারা এই বাংলাদেশকে ধ্বংস করেছে, কেউ অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করেছে, কেউ কলম দিয়ে, কেউ মগজ দিয়ে এই ধ্বংসের বা এই খুনের বৈধতা উৎপাদন করেছে, যারা টকশোতে এসে খুনের বৈধতা উৎপাদন করেছে, তাদের বিচার কীভাবে করবেন? তাদের বিচারটা যেহেতু সরকার করতে পারে নাই সেই জনরোষের ফলাফল এটা। আমি এটাকে মব মানতে রাজি না, বলেন হাসনাত।
তিনি বলেন, যারা এখন হঠাৎ বিএনপিপন্থি হয়েছে তারাই একে মব বলছে। হাসিনা যদি থাকত কিংবা হাসিনা যদি ফিরেও আসে, তাতে তাদের কিছুই হবে না। তারা এখন আওয়ামী লীগের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে একটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করছে।
অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাকে ‘মব অ্যাকশন’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আপনারা যেটাকে মব বলছেন, আমি সেগুলোকে মব বলছি না, এটা প্রেসার। যারা ১৫ বছর ধরে নিপীড়িত হয়েছেন, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও আইন বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন তিনি। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এই সভায় ‘সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ ও ‘জাতীয় গণমাধ্যম কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্রেস সচিব বলেন, ‘আমরা একটি ব্যতিক্রমী সময় অতিক্রম করছি। গণমাধ্যমে একক নিয়ন্ত্রণের যুগ আমরা দেখেছি। শেখ হাসিনার শাসনামলে যেভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, আমরা চাই না সেগুলো আমাদের আমলে হোক। সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো-প্রশাসনিক চাপ, সামাজিক চাপ ও অর্থনৈতিক চাপ।’
তিনি দাবি করেন, ‘মন্ত্রী, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসি থেকে ফোন দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হতো।’ আমরা কাউকে গ্রেপ্তার করছি না, বরং ভুল সংবাদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের জানিয়ে দিচ্ছি, বলেন তিনি।
শফিকুল আলম বলেন, ‘সিএসএ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) বাতিল করা হয়েছে। নতুন সাইবার প্রোটেকশন আইনে কোনো পক্ষের আপত্তি নেই।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে দলীয়করণের মাধ্যমে সাংবাদিকদের নানা সুবিধা দেয়া হতো, যা সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’
শফিকুল আলম অভিযোগ করেন, ‘বিগত সময়ে শেখ হাসিনার পক্ষে কাজ করা কিছু সাংবাদিকের একাউন্টে হাজার কোটি টাকার লেনদেন পাওয়া গেছে। যারা ১৫ বছর ধরে অপ-সাংবাদিকতা করেছেন, তারা এখনো ক্ষমা চাননি। তারা জামায়াত-শিবির বা জঙ্গি তকমা দিয়ে মানুষকে গুমের ভিত্তি তৈরি করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ২৮ জুলাই শীর্ষ কয়েকজন সাংবাদিক শেখ হাসিনাকে মানুষ হত্যায় উসকানি দেন, পুলিশ কেন গুলি করছে না—এমন কথাও তোলা হয়। এখন আবার তারা নতুন সরকারকে সামনে রেখে সেই সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় সক্রিয় হয়েছেন।’
গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘দলের পক্ষ নিয়ে সাংবাদিকতা করলে সেই সাংবাদিকতা আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না। গত ১০ মাসে সরকার চেষ্টা করেছে সাংবাদিকরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।’ সাবেক আমলে তিনটি জাতীয় নির্বাচনের সংবাদ কাভারেজ নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
কেকে/এএস