ভারত বেআইনিভাবে বন্দুক ঠেকিয়ে মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে’ এমন একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ান। শিরোনামে তারা বরাত দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।
প্রতিবেদনটি শুরুতেই বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে হাজার হাজার মানুষকে আটক করছে ভারত। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই মানুষদের অনেকেই যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে পার্শ্ববর্তী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে।
এসব ভারতীয় নাগরিকদের বেআইনিভাবে দেশান্তরের অভিযোগ করেছেন তাদের আইনজীবী এবং ভুক্তভোগীরা। যারা এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছেন, তাদের ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, বিএসএফ বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দেওয়ার কয়েকটি প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ভারতের নাগরিক হওয়ায় এরই মধ্যে দুইশর মতো মানুষকে সে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। তাদের কেউ কেউ বিপজ্জনক পথে মাইলের পর মাইল হেঁটে বাড়িতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ‘অধিকার’ নামের মানবাধিকার সংগঠনের গবেষক তাসকিন ফাহিমা বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার বদলে ভারত মূলত মুসলিম ও নিম্ন আয়ের সম্প্রদায়ের লোকজনকে তাদের নিজের দেশ থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। ভারতের এই ঠেলে দেওয়ার ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, কোনো রকম পরামর্শ ও যাচাই-বাছাই ছাড়া লোকজন পাঠানো বন্ধ করতে অনুরোধ করে ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এসব চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি।
বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া এবং পরে ভারতে ফিরে আসাদের মধ্যে রয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ৬২ বছর বয়সি হাজেরা খাতুন। তার মেয়ে জরিনা খাতুন বলেন, তার মায়ের পরিবারে ভারতে থাকার কাগজপত্র ছিল। তারপরও কীভাবে তিনি বাংলাদেশি হন?
হাজেরা খাতুনকে পুলিশ গত ২৫ মে তুলে নেয় এবং পরের দিন আরো ১৪ জন মুসলিমকে বহনকারী একটি ভ্যানে তুলে। ওই সবাইকে মধ্যরাতে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। হাজেরা খাতুন বলেন, বিএসএফের কর্মকর্তারা সীমান্ত পার হতে বাধ্য করে।
হাজেরা খাতুন বলেন, ‘আমাদেরকে পশুর হিসেবে ব্যবহার করছিল। আমরা প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, আমরা ভারতীয়। আমরা কেন বাংলাদেশে ঢুকব? কিন্তু তারা বন্দুক দিয়ে আমাদের হুমকি দেয়। বলে, যদি ওই পারে না যাস, তবে গুলি করব। যখন ভারতের সীমান্তের ভেতর থেকে চারটি গুলির শব্দ পেলাম, আমরা খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা দ্রুত সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে গেলাম।’
এ দলটিকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা তাদের আটক করে নিয়ে যায় এবং মাঠের মধ্যে একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে আটকিয়ে রাখে। তবে বিজিবি কর্তৃপক্ষও দলটি যে ভারতীয় সেসব কাগজপত্র দেখার পরও বাংলাদেশের বিজিবি থাকার অনুমতি দেয়নি। তাদের একটি ট্রাকে তুলে সীমান্তে নিয়ে ভারতের দিকে হাঁটতে বলা হয়।
হাজেরা খাতুন বলেন, ‘যখন আমরা ফিরছিলাম, সেটা ছিল একটা ভয়ানক ব্যাপার। আমাদের হাঁটতে হয়েছিল কখনো বনাঞ্চল দিয়ে, কখনো নদী পার হতে হয়েছিল। আমরা এতটা ভয় পেয়েছিলাম যে, মনে হলো, যদি বিএসএফ আমাদের ফিরে আসাটা টের পায়, তারা আমাদের মেরে ফেলবে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমরা মরতে যাচ্ছি।’
অবশ্য ৩১ মে হাজেরা খাতুন তার গ্রামে ফিরে আসে। তার পরিবার মনে করে, হাজেরা খাতুন এ ঘটনায় মানসিক বৈকল্যে পড়েছেন।
কথিত অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে এ অভিযান ভারতের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি শুরু করে এপ্রিলে কাশ্মীরে উগ্র ইসলামিপন্থিদের হামলায় ২৫ হিন্দু পর্যটক প্রাণ হারানোর পর। ওই সময় বিজেপি বহিরাগতদের বহিষ্কারের অঙ্গিকার করে বিজেপি। কাশ্মীরের ওই হত্যাকাণ্ডের পর এক দিকে যেমন পাকিস্তানে ‘সিঁদুর’ অভিযান চালায় ভারত, তেমনি অবৈধ বাংলাদেশির জিকির তুলে গণগ্রেফতারও বেড়ে যায় দেশের ভেতরে।
১১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে আসছে, ভারতের নাগরিক ২০ কোটি মুসলিমের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন এবং হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা, যদিও সরকার তা নাকচ করে দেয়। কেবল মুসলিমদেরই তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হয়, আর হিন্দু-শিখসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা সহজেই রেহাই পেয়ে যান।
কেকে/ এমএস