মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সামরিক সংঘাত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গভীর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন ও বাণিজ্যে। এর অভিঘাত থেকে রেহাই পাবে না বাংলাদেশের রফতানিনির্ভর পোশাক শিল্পও। ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্থির হয়ে উঠেছে, পরিবহন ব্যয় বেড়েছে এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও অর্ডার ও লজিস্টিক পরিকল্পনায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
কোভিড-পরবর্তী ধাক্কা সামলে দেশের পোশাক খাত ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে ফিরছিল, তখন এই নতুন যুদ্ধাবস্থা ফের এক অজানা সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-পশ্চিমা দেশগুলোর সংযুক্ত রফতানি পথ এবং কাঁচামালের আমদানিনির্ভরতা বাংলাদেশের পোশাক খাতকে নতুন ধরনের সংকটে ফেলতে পারে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জ্বালানি পরিবাহিত হয় হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে। এ প্রণালিতে যদি যুদ্ধ বা নিরাপত্তাজনিত কারণে সাময়িকও কোনো বিঘ্ন ঘটে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল ও এলএনজির দাম দ্রুত বেড়ে যাবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করেছে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি বন্ধের ইরানি হুমকি বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই প্রণালির মাধ্যমে প্রতিদিন বিশ্বের ২০-৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল ও এলএনজি পরিবাহিত হয়। বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির বড় উৎস কাতার ও ওমান—যাদের গ্যাস সরবরাহও এই রুটের ওপর নির্ভরশীল। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতে বিশেষত পোশাক শিল্পে গুরুতর প্রভাব ফেলবে। ইতোমধ্যে তেলের দাম বেড়ে গেছে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে এবং বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারেন। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, বিমা ও পরিবহন ব্যয়ও আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে। এ ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৫০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে, ফলে রেমিট্যান্সেও ধাক্কা লাগার শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘দেশের পোশাকশিল্প বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে এক সংকটাপন্ন পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, দুর্বল অবকাঠামো, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমরা মারাত্মক চাপে রয়েছি।’ এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আমাদের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সংঘাত যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং এর ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়, তাহলে তার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের শিল্প খাতেও পড়বে। পোশাক খাতও এর বাইরে থাকবে না।’
তবে আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘এই কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকতে এবং শিল্পের সক্ষমতা ধরে রাখতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সব পক্ষের সম্মিলিত সহযোগিতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো।’
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। পোশাক শিল্পের জন্যে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করার জন্য কাজ করা। এসএমই ও নন বন্ডেন্ড পোশাক কারখানাকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া। কাস্টমস ও ভ্যাট নিয়ে কাজ করব। এলডিসি উত্তরণের প্রভাব নিয়ে আমরা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করব, যেন সঠিক সময়ে এলডিসি উত্তরণ ঘটে। মার্কিন শুল্ক নিয়ে কাজ চলছে। এটি যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, পারস্পরিক শুল্ক যেন আমাদের ওপর আরোপ না হয় সেটি নিয়ে কাজ করব। এক্সিট পলিসি নিয়ে কাজ করব, আমরা প্রকৃত এক্সিট পলিসি তৈরি করতে চাই।’
দেশের শিল্প খাতে জ্বালানি হিসেবে এলএনজি’র (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ফলে এ জ্বালানি আমদানিতে কোনো ধরনের সংকট দেখা দিলে তার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর জ্বালানি অর্থনীতির দেশ। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্প খাতের বড় অংশই আমদানিকৃত এলএনজি ও পরিশোধিত তেলের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি হলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ, কৃষি ও পরিবহন খাত এবং সর্বোপরি ভোক্তা পর্যায়ে। এতে দ্রব্যমূল্য বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা চাপে পড়বে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জ্বালানি আমদানির ব্যয় বেড়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি হবে। টাকার মান আরো দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে, যার ফলে সামগ্রিক আমদানি খরচ বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতিও ত্বরান্বিত হবে।’
সেলিম রায়হান বলেন, শুধু অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি নয়, রফতানি খাতেও এর বড় প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। হরমুজ প্রণালিতে বিঘ্ন ঘটলে আমদানি-রফতানিতে বিলম্ব ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে। এতে তৈরি পোশাকশিল্প, যা দেশের প্রধান রফতানি খাত, সেখানে ক্রয়াদেশ বাতিল বা বিলম্বিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান সম্ভাব্য এ সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘হরমুজ প্রণালি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ওই রুট বিপজ্জনক হলে স্বাভাবিকভাবেই জাহাজ পরিচালনাকারীরা সে পথে পণ্য আনা-নেওয়া করতে চাইবেন না। আর যদি করেও, তাহলে বিমা খরচ এত বেশি হয়ে যাবে যে, এলএনজির দাম আকাশছোঁয়া হয়ে উঠবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন খরচ এমনিতেই বেড়ে গেছে। যদি এলএনজির সরবরাহ ব্যাহত হয় বা দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যায়, তাহলে অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যত টিকে থাকতেই পারবে না। এতে দেশের রফতানি আয়, কর্মসংস্থান এবং সার্বিক অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
রফতানি ও সরবরাহ চেইনে বড় ধাক্কা : যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা চাহিদা কমে যাবে, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জ্বালানির দাম ও শিপিং খরচ বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাবে, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি রফতানিকারকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বিশ্ববাজারে অস্থিরতা
জাহাজ চলাচল ও বিনিয়োগে প্রভাব : হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে জাহাজগুলোকে বিকল্প দীর্ঘ রুটে চলতে হবে, এতে ১৫ দিন সময় ও ৩০-৪০ শতাংশ শিপিং ব্যয় বাড়বে। জ্বালানির দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছাড়ালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং চাহিদা হ্রাস পাবে।
শিপিং খরচ ও পণ্যের সরবরাহে বিঘ্ন : লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ হয়ে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ বাড়ছে। এর ফলে বাংলাদেশের আমদানিব্যয় বেড়ে রফতানিতে প্রতিযোগিতা হ্রাস পাবে এবং সময়নির্ভর খাত যেমন পোশাক শিল্পে সংকট দেখা দেবে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে ধাক্কার শঙ্কা : মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশি প্রবাসীদের কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। এতে রেমিট্যান্স হঠাৎ কমে যেতে পারে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি করবে এবং টাকার মান দুর্বল করবে।
মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে : তেল ও পরিবহন খরচ বাড়ার কারণে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে, যা যুদ্ধ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আরও বেড়ে যেতে পারে।
বিনিয়োগ ও উৎপাদনে অনিশ্চয়তা : আন্তর্জাতিক অস্থিরতা ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিদেশি বিনিয়োগ স্থগিত হতে পারে এবং দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারাও সংকুচিত হতে পারেন। এতে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়ে কর্মসংস্থানে হুমকি দেখা দিতে পারে।
তেলের দামে আগুন, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা : ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই তেলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সংঘাতের কারণে ব্রেন্ট ক্রুড ও ডব্লিউটিআই-এর দাম ৭৫-৮১ ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছে। যুদ্ধ আরো তীব্র হলে এটি ৯০-১০০ ডলারেও উঠতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বাড়াবে।
স্বর্ণের দামে নতুন রেকর্ড : যুদ্ধকালীন নিরাপত্তাহীনতায় বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণে ঝুঁকছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ ৩,৪৩৫ ডলার/আউন্সে পৌঁছেছে। থাইল্যান্ডে ভরি প্রতি ৫৩,৩৫০ থাই বাথ ছুঁয়েছে, যা ৬৫ হাজার ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শেয়ারবাজারে ধস : যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে বড় পতন হয়েছে। এসঅ্যান্ডপি, নাসডাক, ডিএএক্স, নিক্কেই, সেনসেক্সসহ প্রধান সূচকগুলো নিম্নমুখী। বিনিয়োগকারীরা এখন নিরাপদ সম্পদ যেমন স্বর্ণ, সরকারি বন্ড ও ডলারে বিনিয়োগ করছেন।
কেকে/এজে