খুঁড়িয়ে চলছে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালসহ জেলার ৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে জেলার সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ, অপারেশন সরঞ্জাম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদ শূন্য থাকার কারণে স্বাস্থ্যসেবার মান মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। জনবল ও চিকিৎসক সংকটে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। অন্যদিকে রোগীর চাপে দায়িত্বরত চিকিৎসকরাও চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বহু রোগীকে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকালটি (ডিএমএফ) ডিগ্রিধারীরা সেবা প্রদান করছেন। এছাড়া উপজেলার অধিকাংশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্স-রে, ইসিজি, আল্টাসনোগ্রাম, ইউরিন টেস্টসহ সব ধরনের টেস্টের সরঞ্জাম সংকট ও জনবল না থাকায় এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
চিকিৎসকের অভাবে জেলার পাঁচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান আপারেশন ও চিকিৎসাসেবা বন্ধ। ফলে অপারেশন থিয়েটারে দীর্ঘদিন ধরে তালা ঝুলছে এবং মূল্যবান যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে রয়েছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন প্রসূতিরা। সরকারি হাসপাতালে সিজার অপারেশন বন্ধ থাকায় শত শত প্রসূতিকে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে যেতে হচ্ছে, যা অতিরিক্ত ব্যয়বহুল এবং অনেকের সামর্থ্যরে বাইরে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষত চা-শ্রমিক সম্প্রদায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী মৌলভীবাজার সদর বা সিলেট যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তাদের আর্থিক ও শারীরিক ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকায় রোগীসহ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
জেলা সদর ও বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা বলেন, এসব হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়া যায় না। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এলেও জেলা শহরের হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বলা হয়।
এদিকে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জেলার সাতটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কমপক্ষে ১০০ চিকিৎসা কর্মকর্তা (মেডিকেল অফিসার) থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ১০ জন। অর্থাৎ প্রায় প্রতি ২ লাখ ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। এর মধ্যে সাত উপজেলা কমপ্লেক্সের পাঁচটি চলছে একজন করে মেডিকেল অফিসার দিয়ে। জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বেশিরভাগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যারও জনবল নেই। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক সংকটের কারণে জরুরি বিভাগ চালু রাখাই দুরূহ হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন রাজনগর, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৪০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নেন। চিকিৎসক সংকটে কুলাউড়া, রাজনগর, জুড়ী ও কমলগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি ও শিশু বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। বেশিরভাগ রোগীকেই রেফার করা হচ্ছে জেলা সদর হাসপাতালে। বিশেষ করে বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া থেকে রোগীদের ৫০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জেলা শহরে যেতে হয়। এ ছাড়া অধিকাংশ হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, ওটি (অপারেশন থিয়েটার), ডেন্টাল চেয়ার এবং অ্যাম্বুলেন্স অচল পড়ে আছে। কয়েকটিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সচল থাকলেও টেকনোলজিস্টের অভাবে সেবা বন্ধ। মৌলভীবাজার সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই কোনো শয্যা। তবে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিতে দুজন চিকিৎসা কর্মকর্তা (মেডিকেল অফিসার) রয়েছেন। কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ চিকিৎসা কর্মকর্তার জায়গায় আছেন মাত্র একজন। এ একজন আবার প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে এখানে অস্ত্রোপচার বন্ধ। প্রায় দুই দশক এক্স-রে টেকনোলজিস্টের পদ শূন্য। হাসপাতালের দুটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি চালকের অভাবে পড়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সটি নষ্ট হয়ে গেছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ অন্যান্য পদে সংকট আরো প্রকট। রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১০ চিকিৎসা কর্মকর্তার জায়গায় আছেন মাত্র দুজন। এর মধ্যে একজন চলতি মাসে চলে যাবেন। এ ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদও শূন্য এখানে। এক্স-রে টেকনিশিয়ানের পদ অনেক দিন ধরেই শূন্য। ফলে এক্স-রে হয় না। ল্যাব টেকনোলজিস্টের দুটি পদই শূন্য। হাসপাতালে কোনো ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের অস্ত্রোপচার। কমলগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নিতে দুজন চিকিৎসক প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। জুনিয়র কনসালট্যান্টপদসহ বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য। বন্ধ রয়েছে অন্তসত্তা নারীর অস্ত্রোপচার। ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও ইসিজি মেশিনগুলো টেকনিশিয়ান না থাকায় সেবা বন্ধ। বড়লেখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১৪ চিকিৎসক থাকার কথা। এখানে রয়েছেন মাত্র তিন চিকিৎসা।
যে তিনজন রয়েছেন, তাদের মধ্যে আবার দুই চিকিৎসক প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন। সিনিয়র স্টাফ নার্সের ২৫টি পদের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ১১ জন। জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও চলছে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ে। একজন চিকিৎসক সপ্তাহে এক দিন আসেন। অথচ প্রয়োজন ১৫ চিকিৎসা কর্মকর্তার। সিনিয়র স্টাফ নার্সের ২৫টি পদের মধ্যে কর্মরত মাত্র সাতজন। বন্ধ রয়েছে গর্ভবতী নারীদের সিজারিয়ান অপারেশন। শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও চলছে মাত্র ৪ জন চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ে। এখানে মোট চিকিৎসক থাকার কথা ২৩ জন। আছেন ১০ জন। সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, জেলায় চিকিৎসা কর্মকর্তা ১৪ জনের বিপরীতে শূন্যপদ রয়েছে ৯টি। মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন ৭ জনের বিপরীতে শূন্য পদ ৬টি। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পাঁচটি পদের চারটিই শূন্য। জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে ৩৯ জনের বিপরীতে শূন্য ১৮টি। স্বাস্থ্য পরিদর্শক থাকার কথা ২০ জন, আছেন ছয়জন। মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ৪১টি পদের ১৮টি শূন্য। সিনিয়র স্টাফ নার্স থাকার কথা ১৬২ জন। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ৫৩টি। এ ছাড়া উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার ২৬ জনের জায়গায় শূন্য রয়েছে ১৮টি পদ। সহকারী সার্জন থাকার কথা ৪২ জন, আছেন আটজন। উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার থাকার কথা ৬৫ জন, শূন্য রয়েছে ৩৬টি পদ। সব মিলিয়ে জেলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ৩৯০টি পদ শূন্য।
এসব বিষয়ে জেলা সদর, রাজনগর, কমলগঞ্জ, জুড়ী, বড়লেখা, কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল সংকটের কারণে সেবার মান অব্যাহত রাখতে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জনবলসংকট ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করা না হলে রোগীদের সেবা আরো অবনতি হতে পারে।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মামুনুর রহমান বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় চিকিৎসক ও জনবল সংকট রয়েছে। এ সংকট দীর্ঘদিনের। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চাহিদা দিয়ে একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে। তারাও আশ্বস্ত করেছেন সংকট সমাধানের।
কেকে/ এএস