৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে একটি নতুন বন্দোবস্তের ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের ৯ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত সেই নতুন বন্দোবস্তের অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পারেনি দেশবাসী। উল্টো নতুন বন্দোবস্তের নামে যা হচ্ছে তাকে ‘লুটপাটের বন্দোবস্ত’ বললে ভুল হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, ‘নতুন বন্দোবস্ত’ কথাটি এখন প্রভাবশালী একটি নীতির প্রতীক। এটি বাস্তবিক অর্থে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে কৌশলে তুলে দেওয়ার নকশা। এই বন্দোবস্তের অন্তরালে চলছে কর ও ঋণ মওকুফ, লাইসেন্স বিতরণ, প্রণোদনা বরাদ্দ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার বশ্যতা নিশ্চিতকরণ।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক গভীর নৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটে নিমজ্জিত। সরকারি পরিসরে ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা’র মোড়কে গোষ্ঠীগত লুটপাট, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। সাম্প্রতিক নানা দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুই উপদেষ্টার ব্যক্তিগত তিন কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের সত্যতাও মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে।
দুদকের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সাবেক দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবি ও মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে। ইতোমধ্যে এই তিনজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধেও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ একাধিক দফতরে প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির অভিযোগের তদন্ত চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপদেষ্টাদের প্রচ্ছন্ন মদদ ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা কোনোভাবেই বড় দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। এক্ষেত্রে এসব দুর্নীতি বা লুটপাটের পিছনে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন তারা। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মাহমুদ হাসান বলেন, ‘উপদেষ্টা পদ আজ প্রশাসনিক সমন্বয়ের বদলে একটি সুবিধাবাদী শক্তির ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা গ্রহণ ইতিবাচক, তবে উচ্চ পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এই ধরনের অভিযান ফলপ্রসূ হবে না।’
শুধু স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নয়, অভিযোগে তীর ছুটেছে প্রধান উপদেষ্টার দিকেও। সাম্প্রতিক সময়ে অধ্যাপক ড. ইউনূসের আর্থিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে গ্রামীণ ব্যাংকের ৬৬৬ কোটি টাকার ঋণের সুদ মওকুফ করা হয়েছে, যা ব্যাংকিং নিয়মনীতি এবং নৈতিকতার ঘোর লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এ ছাড়া করবুকে থাকা গ্রামীণফোনের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে এক ‘বিশেষ বোঝাপড়া’র আওতায়, যার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোনকে একটি যৌথ উদ্যোগে সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে উভয় প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট চরিত্র ও আর্থিক স্বার্থ সংঘাতপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। ড. মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ব্যাংক ও টেলিকম খাতকে এক ছাতার নিচে এনে একরকম প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়িক স্বার্থ ঢুকে পড়েছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এমএ আজিজ গণমাধ্যমের সামনে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের ৬৬৬ কোটি টাকা সুদ মওকুফ, গ্রামীণফোনের চার হাজার কোটি টাকা মওকুফ এবং স্টারলিংককে এই দুই প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব দেওয়ায় দেশবাসীর কী উপকারে লেগেছে?’
এদিকে নতুন করে আলোচনায় এসেছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’ থেকে দেড়শো কোটি টাকা লোপাটের খবর। নগদের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে নানা গ্রুপ-উপ-গ্রুপ জেঁকে বসেছে নগদে। ডাক বিভাগের একটি অংশ নগদের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। আবার নতুন একটি রাজনৈতিক দলের নেতারাও নিয়মিত হস্তক্ষেপ করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশের লাখ লাখ গ্রাহকের জামানত ও নগদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা এগিয়ে এসেছে। তবে তাতে আইনি বাধা সামনে আসছে। নগদ সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকও।
গত আগস্টে সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক পালিয়ে গেলেও তিনি চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নগদ থেকে বেতন নিয়েছেন। মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা করে বেতন নিয়েছেন তানভীর এ মিশুক। বিদেশে গিয়েও নিজস্ব নানা গ্রুপ দিয়ে নগদের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতেই রেখেছেন ডিজিটাল খাতের এই মাফিয়া। ভুয়া বিল ভাউচারে টাকা উত্তোলন, ডাটাবেজ থেকে তথ্য মুছে ফেলা, গণছাঁটাই, ইভেন্ট দেখিয়ে বিল তোলা, মেইনটেন্যান্স কোম্পানির বকেয়া দেখিয়ে নগদ থেকে ২ মাসে অন্তত দেড়শ কোটি টাকা সরানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের সঙ্গে কাজ করছেন আতিক মোর্শেদ নামে এক ব্যক্তি। নগদের কর্মকর্তা না হয়েও এখন নগদের সবকিছু সামলাচ্ছেন এই আতিক। নগদ ভবনের ৬ তলার একই রুমে নিয়মিত অফিস করছেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগদের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আতিক মোর্শেদ নগদে গিয়ে অফিস করছেন। কখনো কখনো সিইও’র চেয়ারেও বসছেন। সম্প্রতি তিনি তার স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা জুঁইকে নগদের ম্যানেজার কমপ্লায়েন্স পদে বসিয়েছেন। চাকরি দিয়েছেন নিকট আত্মীয়দেরও।
দুর্নীতিবিরোধী গবেষক অ্যাডভোকেট তাহমিনা সুলতানা বলেন, ‘নগদের রাজস্বের সঠিক অডিট নেই, স্বচ্ছতা নেই, অথচ প্রতিদিন লাখ লাখ গ্রাহক এই সেবার ওপর নির্ভর করছে। এটি ভবিষ্যতে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘চিন্তা করা যায়, মাত্র কয়েক মাস সুযোগ পেয়েই একটি প্রতিষ্ঠান থেকেই দেড়শ কোটি টাকা লোপাট করেছে। আহা বিপ্লব! আহা চেতনা!’
এদিকে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাসে (২০২৪ সালের জুলাই থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) ২৭ হাজার ১৩০টি সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) পাওয়া গেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭৯ শতাংশ বেশি। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে তিনশ সংসদ সদস্য, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই কাজের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রের নীতি ও সম্পদ একটি ক্ষমতাধর চক্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এতে দুর্নীতির রাষ্ট্রীয়করণ ঘটছে, যেখানে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কিছু ‘নির্বাচিত’ গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণে ব্যবহৃত হয়, তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু আইনি ব্যবস্থা নয়, দরকার একটি জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কেকে/এআর