পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থান থেকে প্রথম স্থানে চলে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। প্রথম স্থানে থাকা চীনের ওপর ১২৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক শেষ পর্যন্ত না কমালে হয়তো দেশটির ক্রয়াদেশ চলে আসবে বাংলাদেশে। তবে এজন্য তৃতীয় অবস্থানধারী ভিয়েতনাম ও ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে হবে বাংলাদেশকে।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে চমক : চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমেরিকান বাজারে এ সময় বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে ১৫০ কোটি ডলারের পোশাক; যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানির পরিমাণ ছিল ১১৮ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য পরিসংখ্যান সংস্থা ওটেক্সার তথ্যের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, এ দুই মাসে দেশটি বিশ্বজুড়ে মোট ১৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালে এই দুই মাসে পোশাক আমদানির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশ ছিল উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বের অন্যান্য প্রধান পোশাক রফতানিকারক দেশের মধ্যে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, পাকিস্তানের ২৩ দশমিক ০৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং চীনের ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
পরিমাণের দিক থেকে (পিস হিসাবে) বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি বেড়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ২৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি পোশাক (পিস) আমদানি করেছে। অন্যদিকে, ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৯০ শতাংশ, পাকিস্তান থেকে ২৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ভিয়েতনাম থেকে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং চীন থেকে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
পিসপ্রতি গড় দামে (ইউনিট প্রাইস) বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ভিয়েতনামের বেড়েছে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ, চীনের ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। তবে ভারতের দাম কমেছে ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ১ দশমিক ৩০ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী ইউনিট প্রাইস বেড়েছে ১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় দেশের অবস্থানকে আরো সুসংহত করবে, তবে আসন্ন চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত থাকাও জরুরি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশি পোশাক খাতের মান ও সক্ষমতার প্রতিফলন। তবে এ ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ধরে রাখা জরুরি।’
৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিত, যা ভাবছেন উদ্যোক্তারা : যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। আগামী তিন মাস বাড়তি শুল্ক গুনতে হবে না রফতানিকারকদের।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের ফলে রফতানিকারকরা বাড়তি সময় পাবেন এবং আলোচনার মাধ্যমে একটি যৌক্তিক জায়গায় পৌঁছানো যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য প্রবেশে রফতানিকারক দেশগুলো যেমন সুবিধা পাচ্ছিল, আমদানিকারক দেশটির ভোক্তারাও কম দামে পণ্য পাচ্ছিলেন। এতে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। তুলনামূলক কম দামের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক বসানোর ফলে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি রাজস্ব পাওয়ার পাশাপাশি রফতানিকারক দেশগুলোকে ঘায়েল করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে। একই সময়ে কানাডা, ব্রাজিল, ইতালি, জাপান, ভারতের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কেও তাদের টানাপড়েন তৈরি হয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের ওপর পড়ে বাড়তি শুল্কের কাশাঘাত।
এ অবস্থায় বুধবার তিন মাসের জন্য নতুন শুল্কনীতি স্থগিত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ৭৫টির বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এসব প্রতিনিধির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ, অর্থ বিভাগ ও ইউএসটিআর রয়েছে। নতুন আরোপিত শুল্ক স্থগিত করা হলেও আগে নির্ধারিত শুল্কসহ ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর থাকবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হবে (১৬+১০) ২৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক আপাতত স্থগিত করলেও সরে আসেনি। সরে আসবে বলেও মনে হয় না। এটা কার্যকর করবেই। তার আগে তিন মাস সময় দিয়ে চীন বাদে অন্য দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়, যাতে দেশগুলো সময় পায়। আবার এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে ওইসব দেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে ছাড়ও দিতে পারে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক কার্যকর থাকলে প্রতি মাসে বাংলাদেশকে ২৪০ মিলিয়ন ডলার লোকসান গুনতে হতো, তিন মাসে যার পরিমাণ ৭২০ মিলিয়ন ডলার হতো। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের গুনতে হতো বাড়তি মূল্য। আগে রফতানি করা পণ্য, যা পথে আছে বা উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে, এমন পণ্যের ওপরও বসত এ শুল্ক। ফলে অনেক কারখানাকে নিঃশেষ হতে হতো। তিন মাস সময় পাওয়ায় রফতানিকারক ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান উভয়ে সময় পাবে। এর মধ্যে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছাতে পারব।
‘পোশাক রফতানিতে শীর্ষে আসতে প্রস্তুত বাংলাদেশ’
সঠিক কৌশল ও সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে পোশাক রফতানিতে এক নম্বর স্থানে উঠতে প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেছেন কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা কিয়াক সুং।
বিনিয়োগ সম্মেলনের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত ‘টেক্সটাইল ও পোশাক’বিষয়ক অধিবেশনে এ কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ বর্তমানে একক দেশ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশের অবস্থান ধরে রেখেছে জানিয়ে কিয়াক সুং বলেন, শীর্ষস্থান অধিকারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উন্নত ও হাতে তৈরি সুতার জন্য নিজস্ব উৎপাদন সুবিধা স্থাপন করতে হবে।
এ সময় তিনি নীতি সহায়তার গুরুত্ব ও বিপুলসংখ্যক বন্ডেড গুদামের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, এগুলো কাঁচামালের দ্রুত প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে। যার ফলে উৎপাদনকারীরা আরো দক্ষতার সঙ্গে পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করতে পারবেন।
সাম্প্রতিক বাণিজ্য উন্নয়নের বিষয়ে মন্তব্য করে সুং বলেন, ট্রাম্প-যুগের শুল্ক নীতির তিন মাসের স্থগিতাদেশ কিছুটা স্বস্তি এনেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তিনি মূল্য সংযোজন উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, আমাদের উচ্চমূল্যের পোশাক উৎপাদনের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। অন্যথায় প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠবে।
কেকে/এএস