বিপুল সম্ভাবনার প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে শেষ হলো জমজমাট বিনিয়োগ সম্মেলন। রাজধানী ঢাকায় নজিরবিহীন এ সম্মেলনে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিডা বলছে, সম্মেলনের সুফল মিলবে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। সম্মেলনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ।
সম্মেলন বিদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে
বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিডা) আয়োজনে চার দিনব্যাপী বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্দা নামে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইউএইসহ রেকর্ডসংখ্যক ৪০টি দেশের খ্যাতনামা বিনিয়োগকারীরা এতে অংশ নেন। পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী ও নীতিনির্ধারকরাও এতে অংশ নিয়েছেন।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত নামিদামি ব্র্যান্ড ইন্ডিটেক্স গ্রুপ, ডিপি ওয়ার্ল্ড, জিওডারনো ও এক্সিলারের এনার্জিসহ কোম্পানির অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিনিয়োগকারী কোম্পানির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে বিনিয়োগ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। আন্তর্জাতিক মহাযান সংস্থা নাসার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নন।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মোটেও পরিবেশ নেই। তাদের এই মনে করার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। অতীতের সরকারের আমলে অনেক বিনিয়োগকারী এ দেশে বিনিয়োগের ইচ্ছা নিয়ে এলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নানা হয়রানি ও অসহযোগিতার কারণে ফিরে গেছেন। এবারের সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করা। আশিক চৌধুরীর ভাষায়, সম্মেলন শেষে অংশগ্রহণকারী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ নিয়ে ফিরে যান, এটিই এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।
আশিক চৌধুরী আগামী ১০ বছর পর বাংলাদেশ কীভাবে বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে সে সম্পর্কে একটি তথ্যপূর্ণ উপস্থাপনা বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরেন।
‘এবারের সম্মেলনে যেসব বিনিয়োগকারী এসেছেন তাদের তালিকা তৈরি করে আগামী ৬ থেকে ১৮ মাস নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুরোধ করা হবে।’
বিনিয়োগ সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা : ১. আগামী মাসে চীন থেকে ২০০ জনের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসবে। তারা বিনিয়োগ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবে।
২. মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সম্পদশালী দেশ সৌদি আরবভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর সরবরাহকারী কোম্পানি ‘সারি’র সঙ্গে একীভূত হয়ে নতুন কোম্পানি গঠন করেছে বাংলাদেশের বি-টু-বি স্টার্টআপ কোম্পানি ‘শপআপ’। নতুন এ কোম্পানির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিল্ক’ গ্রুপ। নতুন গ্রুপ গঠনের পরপরই ১১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে শপআপ।
৩. বাংলাদেশের বাজারে দীর্ঘমেয়াদে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন হোলসিম গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান মার্টিন ক্রিগনার।
৪. চীন ও ভারতের মতো বাংলাদেশে মার্ট চালু করার পরিকল্পনা করছে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বন্দর পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে কার্ড মার্বেল কৃষিপণ্যসহ বাংলাদেশের পণ্য বিশ্ববাজারে তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছেন ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপ চেয়ারম্যান ও সিইও সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম। এ ছাড়া চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগেও তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
৫. বিশ্বের বৃহত্তম ফাস্ট ফ্যাশন গ্রুপ স্পেনের পোশাক জায়েন্ট ইন্ডিটেক্স, যার অধীনে বারশকাও মাসিমো দুত্তির মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ড রয়েছে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চান বলে জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অস্কার গার্সিয়া মাচেইরাস প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশকে এন্ডিটেক্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সোর্সিং হাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
৬. চীনের খ্যাতনামা পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড বাংলাদেশে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। তার মধ্যে ১০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় টেক্সটাইল ও ডাইং খাতে এবং পাঁচ কোটি ডলার রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে পোশাকশিল্পে বিনিয়োগ করা হবে। এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সইও হয়েছে।
৭. সম্মেলনে বিনিয়োগে অবদানের জন্য চার ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেনÑ ওয়ালটন, বিকাশ, স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস ও ফেব্রিক্স। এ ছাড়া বিশেষ ক্যাটাগরিতে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং-কে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
৮. বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন। গত ৮ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধি দল গত ৮ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকালে এ ঘোষণা দেন। এরপর গত ৭ এপ্রিল বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন পরিদর্শন শেষে সেখানে শিল্পপার্কে অবিলম্বে বিনিয়োগের জন্য প্রতিশ্রুতি দেন।
‘বিদেশি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে’ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি জানিয়েছেন এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫-এর সমাপনী প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের প্রস্তাব কিংবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ করা হবে। বিনিয়োগ পেতে করা হবে ধারাবাহিক মনিটরিংও।
তিনি বলেন, ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারী যারা বাংলাদেশে এসেছেন তারা যেন সত্যিকারের বিনিয়োগ করেন, সেজন্য তাদের আমরা ধারাবাহিকভাবে মনিটরিং করব।
তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় নেন বিনিয়োগ করতে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধরে ধরে তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করব। আমাদের এখানে সাড়ে ৫০০ রেজিস্ট্রেশন ছিল, এর মধ্যে প্রায় ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ বিদেশি প্রতিনিধি এসেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের দুজন প্রতিনিধিও এসেছেন। পূর্ণাঙ্গ বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর তথ্য আমরা পরবর্তীতে জানাব।’
তিনি আরো বলেন, বিনিয়োগকারীরা কয়েকটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছেন। যেমনÑ নীতির ধারাবাহিকতা, এক্সেস টু রিসোর্স ও দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ প্রভৃতি। আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা চলছে।’
বিনিয়োগে উচ্চ সম্ভাবনা দেখছেন বিডার কর্মকর্তারা : তারা জানান, বিগত বছরের সম্মেলনগুলো মূলত সেমিনার ও কর্মশালাকেন্দ্রিক আলোচনা ছিল। কিন্তু এবারের সম্মেলন সেমিনার বা কর্মশালায় সীমাবদ্ধ ছিল না।
বিনিয়োগকারী যারা সম্মেলনে আসেন তারা চান তাদের যে সম্ভাব্য অংশীদার বা বি টু বি (ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে ব্যবসা হয়ে থাকে) এবং জি টু জি (যখন কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকার বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যবসায়িক লেনদেন হয়) আলোচনা করতে চায়। এ সম্মেলনে কিছু সেমিনার ও আলোচনা সভা রাখা হয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের ‘বি টু বি’ ও ‘জি টু জি’ আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
গত চার দিন বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে সেমিনার ও যে সেশনগুলো হচ্ছে তারপরও একটা বি টু বি বিকল্প রাখা হয়েছে। তা ছাড়া সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ১০টি সরকারি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক রুম বরাদ্দ রাখা হয়েছে যাতে বিনিয়োগকারীরা সে বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে পারেন। মূলত বিনিয়োগকারীরা যাদের সঙ্গে বিনিয়োগ করবেন তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন।
কেকে/এএস