আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল করছে সরকার। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে দেশের ২৯টি জেলার ডিসি (জেলা প্রশাসক) পরিবর্তন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ উঠেছে- এই ডিসিদের সিংহভাগেরই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আনুগত্য রয়েছে। এই বিষয়টি এখন দেশের সর্বমহলে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরুপ সরকারের ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ততই প্রশ্ন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনের নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব নয়, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতাই হতে হবে প্রধান মানদণ্ড।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সে হিসেবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বাকি মাত্র কয়েক সপ্তাহ। কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন দফতরে- বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনে বড় পরিসরে রদবদল শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থেকে শুরু করে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত পরিবর্তন আসছে দ্রুতগতিতে। প্রশ্ন উঠছে, এখনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়নি, পরিস্কার হয়নি নির্বাচনকালীন ব্যবস্থার বিষয়টিও। তাহলে এই স্বল্প সময়ের জন্য মাঠ প্রশাসনে রদবদলের পেছনে সরকারের কী উদ্দেশ্য? এবং এর প্রভাবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কতটা কার্যকরভাবে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে- সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর পুরো প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে যায়। অর্থাৎ, ডিসি, এসপি, ইউএনও, এমনকি সরকারি দপ্তরের কর্মচারীরাও তখন ইসির নির্দেশে কাজ করেন। ভোটারদের নিরাপত্তা ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমান সুযোগ দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিত করা ইসির অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত একাধিক জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে, তফসিল ঘোষণার পরও প্রশাসনের রদবদল বা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক প্রভাব অব্যাহত থেকেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর প্রয়োজন মনে করলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) পরিবর্তন করতে পারে। কমিশন যদি মনে করে যে, নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ নন বা কোনোভাবে পক্ষপাতদুষ্ট, তাহলে তারা তাদের পরিবর্তন করতে পারে। সে ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব হলো একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। তাই তারা চাইলে নিজেদের মতো করে প্রশাসনিক কাঠামো সাজিয়ে নিতে পারেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন সরকার রদবদল করছে, কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি তা গ্রহণ না করে তাহলে সেটিও তাদের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। এই পরিবর্তনগুলো নির্বাচনের সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না, কারণ শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা কমিশনের হাতেই রয়েছে।’
ডিসি নিয়োগ ঘিরে বিতর্ক আরো গভীর হয়েছে ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে। প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, ডিসি ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটিতে থাকা কেউ কেউ অতীতে জামায়াত ঘনিষ্ঠ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের পক্ষে প্রশাসনকে ব্যবহারের জন্য কাজ করছেন বলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই সম্প্রতি ২৯ জেলার ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্দিষ্ট মতাদর্শিক গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে- ডিসি নিয়োগে ছাত্রজীবনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন কর্মকর্তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারও দলীয় বিবেচনায় ডিসি নিয়োগ দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়নের প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং বিতর্কিত ও অনভিজ্ঞ কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ডিসি হয়েছেন, যাদের অনেকেরই মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা সীমিত। অন্যদিকে, ডিসি ফিটলিস্টে থাকা যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তারা উপেক্ষিত হওয়ায় প্রশাসনের ভেতরে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রথম দফায় ২৮তম বিসিএস ব্যাচের ১৬০ কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ২০ জনকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে মাত্র চারজন শেষ পর্যন্ত নিয়োগ পান, কারণ অধিকাংশই অতীত নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ২৯তম ব্যাচের তুলনামূলক নবীন কর্মকর্তাদের ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়ায় প্রশাসনে বিস্ময় ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা ছিল বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বদলে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়ন করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, উপসচিব পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাই পূর্ববর্তী বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, ফলে অনেক ক্ষেত্রে সেই কর্মকর্তারাই পুনরায় নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জড়িত ৪৩ জন সাবেক ডিসিকে ওএসডি করা হয় এবং ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার যারা ডিসি হয়েছেন তারাই জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনি ঝুঁকি বিবেচনায় অনেক যোগ্য কর্মকর্তা এখন ডিসি পদে নিয়োগ নিতে অনিচ্ছুক। ফলে সরকার অভিজ্ঞতা ও পদমর্যাদার শর্ত শিথিল করে ২৫তম থেকে ২৯তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দিচ্ছে, এমনকি অনেকে ইউএনও বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ না করেও ডিসি হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারাই নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার, ভোটকেন্দ্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচনী কর্মী ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে থাকেন। ফলে ডিসি নিয়োগ বা বদলির পেছনে একদিকে প্রশাসনকে ‘নির্বাচনের উপযোগী’ করা। অন্যদিকে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা থাকতে পারে। অনেকেই বলছেন, মাঠ প্রশাসনের ডিসি-এসপি নিয়োগ ও বদলি জামায়াতের সুপারিশের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে। মাঠ প্রশাসনে জামায়াতে ইসলামী-অনুগত কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে। যদি রাজনৈতিক প্রভাবের আলোকে- বিশেষ করে জামায়াতসহ কোনো গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতায় নিয়োগ হয়- তাহলে তা নির্বাচন বিশ্বস্ততা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিংকগুলোর একটি হচ্ছে জেলা প্রশাসক। তারা রিটার্নিং অফিসার-রূপে নির্বাচন পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন। ভোটকেন্দ্র, আইনশৃঙ্খলা ও জনসচেতনায় তাদের অবদান থাকে। ফলে নির্বাচন সামনে রেখেই গত ৮ ও ৯ নভেম্বর দুই দিনে মোট ২৯টি জেলাতে ডিসি নিয়োগ ও বদলির প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের কাঠামোকে দ্রুত, দক্ষ ও নির্বাচনের উপযোগী করতে এই রদবদল আনা হয়েছে। নিয়োগ-বদলি সম্পূর্ণভাবে প্রশাসনিক প্রয়োজনে করা হয়েছে। যারা বদলি হয়েছেন বা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘ডিসি পদে নিয়োগে যোগ্যতা, মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতার পাশাপাশি এখন রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করছে। এতে মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ছে। জামায়াত সংশ্লিষ্টরা প্রশাসনের ভেতরে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয়। দীর্ঘ সময় ধরে সরকারবিরোধী অবস্থান নেওয়া এই দলটি বর্তমানে প্রশাসনে ‘নীরব প্রভাব’ বিস্তারের মাধ্যমে মাঠে উপস্থিতি টিকিয়ে রাখছে।
সূত্র জানায়, প্রশাসনে নিয়োগ ও পদায়নে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে নিয়োগ দেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু দলীয় আনুগত্যেই যেন নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনকে দ্রুত রদবদল করার তৎপরতা রয়েছে- কিন্তু এই তৎপরতার সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে প্রশাসনের বড় পদে জামায়াতঘেঁষাদের পদায়ন করা হয়েছে। ফলে মাঠ প্রশাসন ও কিছু মন্ত্রণালয়ে ‘জামায়াতের বলয়’ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময় প্রশাসনে জামায়াত ও তার সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন। তারা মাঠ প্রশাসনকে নির্বাচনমুখী করে সাজানোর পাশাপাশি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের আগে ঘন ঘন রদবদল মাঠ পর্যায়ের কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট করছে। ডিসি বদলির ফলে উন্নয়ন কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে, নতুন কর্মকর্তারা জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভ্যস্ত হতে সময় নেন। নির্বাচনের আগে প্রশাসনের অস্থিরতা উন্নয়ন ও জনগণের আস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো- যদি মাঠ প্রশাসনে রাজনৈতিক আনুগত্য প্রাধান্য পায়, তাহলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
কেকে/এআর