প্রায় প্রতিটি আসনেই একাধিক যোগ্য প্রার্থী বিএনপির মনোনয়ন চেয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। কোনো কোনো আসনে সেই সংখ্যাটা ছিল এক ডজন। এর মধ্যে ছিলেন সাবেক এমপি, মন্ত্রী এবং দলের হেভিওয়েট নেতা। ফলে প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম।
সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ উতরে গত সোমবার ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। তবে একদিন পরই অনিবার্য কারণ দেখিয়ে মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনে কামাল জামান মোল্লার দলীয় মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। বাকি ৬৩ আসনে কৌশলগত কারণে জোটের শরিকদের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে।
যদিও মনোনয়ন ঘোষণাকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এটা চূড়ান্ত মনোনয়ন নয়, যে কোনো আসনে পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়লে মনোনয়ন পরিবর্তন করতে পারে দলের স্থায়ী কমিটি। মনোনয়ন বঞ্চিতদের হতাশ না হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই মনোনয়নবঞ্চিত সহস্রাধিক নেতা অনেকটা হতাশ। এর মধ্যে সাবেক এমপি যারা ছিলেন তাদের মধ্যে হতাশা বেশি। রাত থেকেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে বেশ কয়েকজন নেতার সমর্থকরা। সড়কপথ, রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। যদিও দলের হাইকমান্ড থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে—কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলেই বহিষ্কারের খড়গ নেমে আসবে। আখেরে কী সিদ্ধান্ত নেবেন মনোনয়নবঞ্চিত এসব নেতা। তারা কি দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন, নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনি মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? নাকি নিজেকে গুটিয়ে রেখে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করবেন?
তবে মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ মনোনয়নবঞ্চিত নেতা দলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মাঠে নেমে কাজ করবেন। ইতোমধ্যে অনেকে মনোনয়ন পাওয়া নেতাকে অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে বেশ কয়েকজন নেতা ক্ষোভে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। অনেকে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজন নেতা মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে সে সংখ্যাটা হাতেগোনা গুটিকয়েক হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়নবঞ্চিত যেসব প্রার্থী দলীয় আনুগত্য দেখিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন ভবিষ্যতে তাদের আরো বড় পুরস্কার দিতে পারেন বিএনপির হাইকমান্ড।
গত ২৭ অক্টোবর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের দলীয় প্রার্থীদের সামনে এক আবেগঘন বক্তব্য দেন তারেক রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুন ও সীমাহীন ত্যাগের কথা স্মরণ করেন তিনি। এসময় মনোনয়নের বিষয়টি তুলে ধরে একটি উদাহরণ টেনে তারেক রহমান বলেন, ‘দুই মায়ের মধ্যে এক সন্তানের দাবিতে বিচারক বলেছিলেন, সন্তানকে দুভাগ করে দেবেন। তখন আসল মা বলেছিলেন, সন্তানকে ভাগ করবেন না, অন্যজনকেই দিন—আমি দূর থেকে দেখব। আসল মা তিনিই, যিনি সন্তানের ক্ষতি হতে দেননি। আমি চাই আপনারা সেই আসল মায়ের মতো হোন। ঐক্যের স্বার্থে ত্যাগ শিখুন।’ তারেক রহমানের ওই বক্তব্যের পর এক আসনের একাধিক প্রার্থী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করেন।
বরিশাল সদর আসনে মনোনয়ন চেয়ে আসছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। প্রার্থী তালিকায় তার নামও রাখা হয়নি। মনোনয়নের বিষয় নিয়ে দলের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আলাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে মনোনয়ন চেয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। ওই আসনটি জোটের প্রার্থীর জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘আমি দলের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে আমার শক্তি জনগণ। আমি জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও জনগণের জন্য কাজ করে যাব।’
ভোলা-৩ আসনের তিনবারের সাবেক এমপি নাজিম উদ্দীন আলমকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তার আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন। দলীয় সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন নাজিমউদ্দীন আলম। তিনি বলেন, ‘আমি জন্মলগ্ন থেকে বিএনপি করি। আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে ছিলাম। এখনো পেটে গুলি রয়েছে। তবে দলের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমি দলের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি ধানের শীষের পক্ষে কাজ করব।’ নুরুল ইসলাম নয়নকে বাসার দরজা না খোলার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি বাসায় ছিলাম না।’
কুষ্টিয়া-১ আসনের মনোনয়ন চেয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শরিফউদ্দিন জুয়েল। তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। দলের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে শরীফ উদ্দিন জুয়েল বলেন, ‘দল প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দিয়েছে। এটাই যেহেতু চূড়ান্ত নয়, আমরা দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে অনুগত থাকব।’
গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে মনোনয়ন চেয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান সোহাগ। মাঠ পর্যায়ে তার অবস্থান ভালো থাকলেও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে আরেক প্রার্থী ফারুক আলম সরকারের। এ বিষয়ে সোহাগ বলেন, ‘দল সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যার নাম ঘোষণা করেছে মাঠের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক না। কারণ বিগত দিনে দলীয় কোনো কর্মসূচি বা নেতাকর্মীদের বিপদে তাকে পাওয়া যায়নি। উল্টো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছিল তার সখ্য। অপরদিকে দল ও আন্দোলন সচল রাখতে আমি সব সময় মাঠে থেকেছি। আওয়ামী স্বৈরাচারের আমলে আমি হামলা-মামলা, জেল-জুলুম এবং ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এমনকি ২০২১ সালে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ১৭ টি ব্যাংক হিসাব বিএফআইইউ দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।’ এলাকার তরুণ ভোটারদের অবস্থান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সাঘাটা-ফুলছড়ির ৫৬ হাজার তরুণ ভোটারের প্রতিনিধিত্বর দিক বিবেচনায় নিলে একমাত্র আমি মনোনয়নের দাবিদার।’
কামরুজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘আমি মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার জন্য দলের হাই-কমান্ড বরাবর আবেদন করেছি। আমার বিশ্বাস দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি বিবেচনা করবেন। যদি সম্ভাব্য প্রার্থীর চেয়ে আমি বেশি যোগ্য হই তাহলে অবশ্যই চূড়ান্তভাবে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তবুও যদি দল আমাকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন না দেয় আমি সেই সিদ্ধান্ত নত মস্তকে মেনে নেব। কারণ আমার রক্ত বিএনপির রক্ত, আর রক্ত কখনো বেইমানি করে না।’
কিছু আসনে মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভ : এদিকে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে মনোনয়ন চেয়ে আসছিলেন সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তার অনুসারীরা দুদিন ধরে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন। এদিকে কুমিল্লা-৬ আসনের মনোনয়ন চেয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিন। তাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় রাতেই কুমিল্লায় মহাসড়ক অবরোধ করেন তার অনুসারীরা। মনোনয়ন নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিন বলেন, ‘আল্লাহ পাক যা কিছুই করেন তা মানুষের কল্যাণের জন্য। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো আল্লাহ পাক একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ পাক যেন আমাকে সেই তৌফিক দেন।’
মাদারীপুর-১ আসনে মনোনয়ন না পেয়ে রাতেই ঢাকা-ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করেন লাভলু সিদ্দিকীর কর্মী-সমর্থকরা। সমালোচনার মুখে ওই আসনে নাম ঘোষণার এক দিন পরই অনিবার্য কারণ দেখিয়ে কামাল জামান মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত করা হয়েছে। কুষ্টিয়া-৩ আসনে মনোনয়ন না পেয়ে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিএনপির স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক ও তিনবারের সাবেক এমপি অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনের সমর্থকরা। ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে ট্রেন আটকে রেলপথ অবরোধ করেন আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরনের সমর্থকরা। ফরিদগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ হান্নানকে মনোনয়ন না দেওয়ায় সড়ক অবরোধ করে ফরিদগঞ্জ উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিক্ষোভ।
নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন যারা : মনোনয়ন না পেলে ইতোমধ্যে দলীয় পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা। দলীয় মনোনয়ন পেলেও লক্ষ্মীপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন নিজান। সিলেট-৫ আসন থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ চাকসু মামুন। অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ ছেড়ে ঝিনাইদহ-১ আসন থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান। ওই আসনটি ফাঁকা রাখা হয়েছে। ওই আসনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন।
কেকে/এজে