ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। গত সোমবার সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপরসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অবশ্য গতকাল মঙ্গলবার মাদারীপুর-১ আসনে কামাল জামাল মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। ফলে সব মিলিয়ে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ৬৪ আসনে দলটির মনোনয়ন ফাঁকা রয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একাধিক আসনে প্রর্থী হয়েছেন। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বগুড়া-৬ (সদর) আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন। এদিকে ফাঁকা ৬৪টি আসন নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। এ আসনগুলোয় কাদের প্রার্থী করা হবে, জোটের শরিকদের কি আসনগুলো ছেড়ে দেওয়া হবে কিনা, বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা করে আসনগুলো ফাঁকা রাখা হয়েছে কিনা- রাজনীতির মাঠে এখন এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি ফাঁকা রাখা আসনগুলোর বেশ কিছুতে বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থীও রয়েছেন, যারা মনোনয়ন পেলে অনায়াসে জয় পাবেন। আবার ভুল মনোনয়নে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে আসনগুলো। যদিও আসনগুলো নিয়ে বিএনপির দলীয়ভাবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় দল হিসেবে প্রতি আসনেই বিএনপির একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। যা দলটির জন্য এক মধুর সমস্যাও। এসব কারণে রুহুল কবীর রিজভী, রুমিন ফারহানা বা হাবীব উন নবী খান সোহেলের মতো হেভিওয়টে নেতারাও মনোনয়ন পাননি। তারা বলছেন, বিএনপি প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। তবে ফাঁকা আসনগুলোয়ও সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এ আসনগুলোর মধ্যে কিছু আসন হয়তো জোট শরিক ও কৌশলগত কারণে সমমনা রাজনৈতিক দলের জন্য ছাড় দেবে বিএনপি। তবে অনেক আসনই আছে, যেগুলোতে দলীয় যোগ্য প্রার্থী না দিলে প্রতিপক্ষ সুযোগ নিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে। বিএনপির ভুল প্রার্থী বাছাই তাই জামায়াতকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। সে কারণে ফাঁকা আসনগুলোর ক্ষেত্রের বিএনপিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী বাছাই করতে হবে।
ফাঁকা রাখা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ আসনের একটি গুলশান-বনানী এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসন। এ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালীব রহমান পার্থ ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে এ আসনে প্রতীক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধানের শীষ প্রতীকই এ আসনে জয়ের মূল চাবিকাঠি হবে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন। এ ক্ষেত্রে এই আসনে বিএনপির নিজস্ব প্রার্থী থাকলে জয় অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন খালেদা জিয়ার ভাগনে প্রকৌশলী শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন। যদিও তিনি নীলফামারী-১ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এ আসনটিতেও কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নীলফামারী-১ আসনে প্রকৌশলী তুহিনকে প্রার্থী করা হলে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনেকেই ধারণা করছেন হেফাজত ও জমিয়তের সঙ্গে জোট হতে পারে বিএনপির। জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নির্বাচনি এলাকা এটি। হয়তো জোটগতভাবে নির্বাচন করলে আসনটি জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীকে জোটের প্রার্থী ঘোষণা করতে পারে দলটি। তবে সেক্ষেত্রে জামায়াতের প্রার্থীর কাছে আসনটি হারাতে পারে বিএনপি। অন্যদিকে নীলফামারী-১ আসনে যদি প্রকৌশলী তুহিনকে না দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে ঢাকা-১৭ আসনে তাকে প্রার্থী করা হলেও সেটি বিএনপির দখলে থাকবে। না হলে জামায়াত সুবিধা পেয়ে যাবে।
অন্যদিকে ঢাকা-৯ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারেন হাবীব উন নবী সোহলে। তবে জোট হলে এ আসনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নিউমার্কেট-ধানমন্ডি এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১০ আসনে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন। তবে এ আসনে তারেকপত্নী জোবাইদা রহমানকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এদিকে ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনে আলহাজ তমিজ উদ্দিন ও সাবেক ছাত্রদল নেতা নাজমুল হাসান অভি জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন।
এদিকে গাজীপুর-১ আসনে কাজী ছাইদুল আনাম বাবুল ও ব্যারিস্টার ইশরাক আহমেদ চৌধুরীর যে কোনো একজন যদি মনোনয়ন পান, সেক্ষেত্র আসনটি বিএনপি জয় করতে পারবে। না হলে হাতছাড়া হতে পারে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সদ্যগঠিত গাজীপুর-৬ আসনে বিএনপির শক্তিাশালী প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। এ ছাড়া গাজীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মাজহারুল আলমকেও এ আসনে নমিনেশন দেওয়া হতে পারে। তবে এ দুজনকে বাদ দিয়ে যদি জোট সঙ্গীকে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে আসনটি জামায়াতের দখলে চলে যাবে।
এদিকে মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনটি খেলাফত মজলিসকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। তাহলে আসনটি জামায়াতের কাছে হারাতে পারে বিএনপি। কিন্তু দলীয় কামরুজ্জামান রতন বা মহিউদ্দিন আহম্মেদ যদি প্রার্থী হন, তবে আসনটি বিএনপি দখলে নিতে পারবে। নরসিংদী-৩ আসনে (শিবপুর) জনসংযোগ চালিয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর এলাহী এবং মো. একরামুল হাসান মিন্টু মোল্লা।
দুজনই স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মনির হোসেন কাসেমীকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে এ আসনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিন হতে পারেন বিএনপির নিরাপদ প্রার্থী। এদিকে মানিকগঞ্জ-১ আসনে এসএ কবির জিন্নাহ ও আকবর হোসেন বাবলু জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে আকবর হোসেন বাবলু বিএনপির সাবেক মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। কিশোরগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারেন মাজহারুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের ঘাঁটিখ্যাত ফরিদপুর-১ আসনে খন্দকার নাসিরুল ইসলাম হতে পারেন বিএনপির তুরুপের তাস। এ ছাড়া শামসুদ্দিন মিয়া ঝুনুও জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন। জানা গেছে, এ আসনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন ফ্যাসিস্টের দোসর আরিফুর রহমান দোলন। ফাঁকা থাকা মাদারীপুর-২ আসনে বিএনপির বাইরের প্রার্থী দিলে আসনটি হারাতে হতে পারে বলে স্থানীয়দের মত। সেক্ষেত্রে হেলেন জেরিন খান বা জাহান্দার আলী জাহান হতে পারেন বিএনপির উপযুক্ত প্রার্থী। রাজবাড়ী-২ আসনে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য জনপ্রিয়তা এগিয়ে রয়েছেন।
এদিকে চট্টগ্রাম-৯ আসনে বিএনপির প্রয়াতন নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানের ছেলে সাঈদ আল নোমান পেতে পারেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনেও সাঈদ আল নোমানের নাম আলোচনায় আছে। এ আসনে তারেকপত্নী জোবাইদা রহমানও প্রার্থী হতে পারেন বলে স্থানীয় বিএনপি মনে করে। তবে আসনটি যদি জোটসঙ্গীদের ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে হাতছাড়া হয়ে যাবে।
বরিশাল-৩ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তবে জোট হলে আসনটি এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। পটুয়াখালী-২ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন। অনদিকে পটুয়াখালী-৩ আসনটি গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। বাগেরহাট-২ আসনে বিএনপির এমএ সালাম এগিয়ে রয়েছেন। নড়াইল-২ আসনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম এগিয়ে রয়েছেন।
লালমনিরহাট-২ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারেন রোকনউদ্দিন বাবলু বা জাহাঙ্গীর আলম। ঠাকুরগাঁও-২ আসন ধরে রাখতে হলে দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেই প্রার্থী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন নোকর্মীরা।
হবিগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে সিলেট-৪ আসনে সাবেক মেয়র আরিফুল হক মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। সুমানগঞ্জ-২ আসনে সাবেক বিচারপতি মিফতা উদ্দিন চৌধুরী রুমী জনপ্রিয়তায় এগিয়ে। এ আসনে জোটের প্রার্থী দিলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। সুনামগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির হয়ে জনসংযোগ করছেন জয়নুল জাকেরীন। তিনি মনোনয়ন পেলে আসনটিতে বিএনপি পাস করবে বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা আত্মবিশ্বাসী।
কেকে/এআর