কক্সবাজার লাবণী পয়েন্ট থেকে শুরু করে সুগন্ধা পয়েন্ট হয়ে সায়মন হোটেল পর্যন্ত কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাতে আলোকিত রাখার জন্য বাতি লাগিয়েছিল। সম্প্রতি দেখা গেছে, অনেক বাতিই জ্বলছে না। বন্ধ রাখা হয়েছে বাতিগুলো। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়- রাতের অন্ধকার দূরীকরণের জন্য বাতি লাগানো হয়- তার অনেক বাতি নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে রাত হলেই সড়কে নেমে আসে ভুতুড়ে পরিবেশ। আর অন্ধকারে এলাকায় বেড়ে গেছে চুরি-ছিনতাই। অন্যদিকে কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতও এখন সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকারে ডুবে যায়। বিশ্বের দীর্ঘতম এ সৈকতে তিনটি পয়েন্ট ছাড়া কোথাও নেই আলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছিনতাই, ইভটিজিং ও অন্যান্য অপরাধ বেড়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সৈকতে ২০১৭ সালে স্থাপন করা হয়েছিল ১১৩টি পোল লাইট, খরচ হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সচল আছে মাত্র ৩৫টি, বাকি ৭৮টি বিকল।
সরেজমিন দেখা গেছে, সৈকতের কলাতলী পয়েন্টের মূল প্রবেশপথের দক্ষিণে কোনো লাইট নেই। কয়েকটি হোটেলের লাইটের আলোতে কিছুটা আলোকিত সৈকত। ওই আলোতেই হাঁটছিল পর্যটকরা। কলাতলী পয়েন্ট থেকে সৈকতের পাড় বেয়ে সুগন্ধা পয়েন্ট আসার সময় প্রতিটি পিলারে বাতি (পোল লাইট) চোখে পড়ে। কিন্তু, একটি বাতিও জ্বলছে না। সুগন্ধা বিচের উত্তর থেকে দক্ষিণে পর্যন্ত ৪টি এলইডি বাতি (স্ট্রিট লাইট) দেখা যায়। সুগন্ধা বিচ থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত কোনো বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। লাবণী বিচে ৪টি এলইডি লাইট জ্বলছিল। তবে, কয়েকটি লাইট জ্বলতে দেখা গেলেও তা ছিল অস্পষ্ট। মিটমিট করে জ্বলে আবার বন্ধ হয়।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ২০১৭ সালের দিকে ডায়াবেটিস পয়েন্ট থেকে কলাতলী সৈকত পর্যন্ত ১১৩টি পোল লাইট (স্ট্রিট লাইট) স্থাপন করা হয়েছিল। যেগুলোর একেকটি দূরত্ব ৮০ মিটার। যেগুলোর খরচ পড়েছে ১৫ লাখ টাকা। পিলার ছাড়াও ভবনের কোণায় লাগানো হয়েছে ৩২টি সিসি ক্যামেরা এবং সেগুলো মনিটরিং করা হয় লাবণী বিচের জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্র থেকে। পাশাপাশি টুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকেও স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১১৩টি পোল লাইটের মধ্যে ৩৫টি সচল আছে এবং বাকি ৭৮টি বাতি বিকল। রোদ, বৃষ্টির পানি, লবণাক্ত হাওয়া বৈদ্যুতিক তার ও পুঁতি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিকল হয়ে পড়ে এসব বাতি। এ ছাড়া গত বর্ষা মৌসুমে ঢলের পানিতে বৈদ্যুতিক পিলার পড়ে যাওয়ার কারণে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও অনেক লাইট চুরি হয়ে যায়।
নাম জানাতে অনিচ্ছুক, জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, ‘সৈকতকে আলোকিত করতে, ১০ বছর আগে ১১৯টি পোল লাইট (ফ্লাড বাতি) কেনা হয়েছিল। বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অর্থায়নে এসব বাতির মধ্যে ৬টি বিমানবন্দরে সীমানায় ঢুকে পড়ে। শাহীন বিচ (ডায়াবেটিস পয়েন্ট) থেকে কলাতলী বিচ পর্যন্ত ১১৩টি লাইটের মধ্যে আছে ৮০টির মতো। বাকি লাইটগুলো চুরি হয়ে গেছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এক বছর গত হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এটি তাদের ব্যর্থতা বলা যায়। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইয়ামিন হোসেন থাকাকালে চট্টগ্রাম থেকে ৪০০ ওয়াটের ১০০টি এলইডি ফ্লাড বাতি কেনা হয়। যেগুলো ৫০টির মতো বাতি সৈকতের বৈদ্যুতিক পিলারে স্থাপন করা হয়েছিল। বাকি ৫০টি এলইডি বাতির হদিস মেলেনি। যার আনুমানিক দাম ১০ লাখ টাকা। যদিও জেলা প্রশাসন বলছে, সবকটি বাতিই লাগানো হয়েছিল। রাতের বেলায় অনেক বাতি চুরি হয়ে গেছে। তার মধ্যে, ৩০-৩৫টি বর্তমানে সচল রয়েছে। পর্যটকরা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা নামলেই সৈকতজুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ। চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনার কারণে তারা সৈকতে চলাফেরা করতে ভয় পায়।
চট্টগ্রাম বহদ্দারহাট বাড়ি পাড়া থেকে আসা পর্যটক আব্বাস উদ্দিন। যিনি একজন ব্যবসায়ী। কথা হলে তিনি বলেন, ‘এতবড় একটা পর্যটন শহরের সৈকতে বাতি জ্বলে না। এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। তার সঙ্গে থাকা আজিজুল হক বলেন, গত শুক্রবার দুপুরের দিকে কক্সবাজার পৌঁছায়। সন্ধ্যায় কলাতলী থেকে হেঁটে সুগন্ধা বিচে এলাম। মাঝখানে পুরোপুরি অন্ধকার। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। জলতরঙ্গের পশ্চিমে কিটকটে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন একঝাঁক তরুণ। ছয়টি কিটকটে বসে ব্লুটুথ বাজিয়ে গান শুনছিলেন। তারা জানান, সি-গালের বিপরীতে বসতে চেয়েছিলেন। আলো না থাকায় এদিকে জলতরঙ্গের পশ্চিমে বসলেন। এক বছর পর কক্সবাজার এলেন তারা। বললেন, কোনো পরিবর্তন নেই, আগে কিছুটা আলো দেখেছিলাম। কিন্তু, এবার চারদিকে অন্ধকার।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক বছর ধরে অন্ধকারে সৈকত। জেলা প্রশাসনের বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি প্রতি বছর কোটি টাকার রাজস্ব নেয়। তারা এত টাকা কি করে? সৈকতজুড়ে, ঘোড়ার মলমূত্র, পলিথিন, ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। যেন তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। প্রতিদিন কক্সবাজারে হাজার হাজার পর্যটক আসে। তারা যে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াবে সেই পরিস্থিতি নেই। সন্ধ্যার পরে চারদিকে অন্ধকার। অনেক পর্যটক ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। এর পরে-ও যেন কর্তৃপক্ষের হুঁশ আসছে না। বৃহত্তর সুগন্ধা বিচ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘ঝিনুকের দোকানের আলোতে আলোকিত পুরো সৈকত। পিলারে কয়টি এলইডি বাতি জ্বললেও অধিকাংশ বাতি নষ্ট। এতে করে পর্যটকরা রাতের বেলায় ঘোরাঘুরি করতে ভয় পায়।’
কক্সবাজার বিচ কিটকট মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সোহেল বলেন, ‘আলোর মধ্যে যেসব কিককট বসানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পর্যটকরা বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। লাবণী থেকে কলাতলী পর্যন্ত সৈকতের অধিকাংশ জায়গা অন্ধকার। ওইসব স্থানে যাদের কিককট আছে, তারা ব্যবসা করতে পারে না। দিনের বেলায় যা হওয়ার হয়। তা-ও সরকারি ছুটির দিনে।’
পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, ‘১১৩টি স্ট্রিট লাইটের (পোল লাইট) মধ্যে ৩৫টির মতো সচল আছে। নতুন লাইট কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তায় ৩২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. শাহিদুল আলম বলেন, নতুন বাতি ক্রয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। শিগগির সব বাতি প্রতিস্থাপন হয়ে যাবে।
জেলা প্রশাসক মো. আ. মান্নান বলেন, ‘লাইট ক্রয় করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সৈকতে নতুন এলইডি (ফ্লাড লাইট) বাতি বসানো হবে।’
টুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আপেল মাহমুদ বলেন, চুরি ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছেন টুরিস্ট পুলিশ। প্রতিদিন দুই শিফটে পুলিশের সদস্যরা ডিউটি করেন। ঝাউবাগান ছাড়াও রাতে সড়কের বিভিন্ন মোড়ে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হচ্ছে। টুরিস্ট পুলিশের অবস্থানের কারণে অপরাধীরা এখন আর আগের মতো সৈকত এলাকায় আসে না। অপরাধী শনাক্তে বিচ এলাকায় ২৭টিসহ ৩৩টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। যার মধ্যে ৮-১০টি মেরামত করতে হবে। আরো ১৭টি নতুন সিসি ক্যামেরা কেনা হয়েছে। এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসানো হবে। সৈকতের বাতির বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে বাতি স্থাপনের কাজ শুরু হবে জানিয়েছেন।
কেকে/এআর