বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। জুলাই সনদের পর যে প্রশ্নটি ক্রমেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে, তা হলো- জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা হবে কি না। কেউ বলছেন, আগে গণভোট, তারপর নির্বাচন। আবার কেউ বলছেন, নির্বাচন-পরবর্তী সময়েই গণভোট করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে- জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজন করা।
এমন প্রস্তাব কেবল আবেগের বিষয় নয়, এটি সময়, ব্যয় ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে নিবিড়ভাবে যুক্তিযুক্ত একটি ধারণা।
যে কোনো গণভোটের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো- জনগণের অংশগ্রহণ। বিশ্বের নানা দেশে দেখা গেছে, আলাদা করে রেফারেন্ডাম আয়োজন করলে ভোটার উপস্থিতি অনেক কমে যায়। কিন্তু নির্বাচনের দিনেই যদি গণভোট হয়, তাহলে ভোটাররা যেহেতু মাঠে উপস্থিত থাকেন, তাদের অংশগ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। এর ফলে গণভোটের ফলাফল জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হিসাবে গণ্য হয়। অর্থাৎ, নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট একত্র করলে সিদ্ধান্তের সামাজিক বৈধতা অনেক বেশি হয়।
নির্বাচন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল ও বিশাল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। আলাদা দিনে গণভোট করলে নিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্র, কর্মকর্তা, ব্যালটপত্র, পরিবহন- সবকিছুর জন্য নতুন করে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু একই দিনে দুটি ভোট হলে একই অবকাঠামো ব্যবহার করা যায়। এতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ কমে, এবং করদাতাদের অর্থ সাশ্রয় হয়। অনেক দেশেই নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট আয়োজন করে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো হয়েছে- বাংলাদেশও সেই মডেল অনুসরণ করতে পারে।
আলাদা আলাদা ভোট আয়োজন করলে জনগণ দ্রুত ভোট-অবসাদে ভোগে। ভোটে যাওয়া, লাইনে দাঁড়ানো, সময় ব্যয়- এসব কারণে দ্বিতীয় ভোটে অনেকেই অনুপস্থিত থাকে। ফলে রেফারেন্ডামের অংশগ্রহণ কমে যায় এবং সিদ্ধান্তের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের দিনেই যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে জনগণ একই উপস্থিতিতে দুটি নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। এতে ভোটারদের সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচে এবং সার্বিক অংশগ্রহণও বাড়ে।
গণভোট সাধারণত সংবিধান বা রাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কিত গুরুতর সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত থাকে। নির্বাচনের আগে আলাদা গণভোট আয়োজন করলে দীর্ঘ সময় অনিশ্চয়তা থেকে যায়। অথচ একই দিনে ভোট হলে জনগণ একইসঙ্গে সরকার বেছে নেয় এবং নীতিগত দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করে। এর ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্থিতিশীল হয়, নতুন সরকারও পায় একটি স্পষ্ট ম্যান্ডেট।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব একটি বড় সংকট। গণভোটের মতো সংবেদনশীল ইস্যু আলাদা দিনে করলে তা বিরোধ ও সন্দেহের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের দিনেই করলে প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, পর্যবেক্ষক- সবকিছু ইতোমধ্যেই সক্রিয় থাকে, ফলে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা সহজ হয়। একইসঙ্গে এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সুযোগও তৈরি কওে, সব পক্ষই তখন নির্বাচনি মাঠে সমানভাবে উপস্থিত থাকে।
অবশ্যই, কেউ কেউ বলবেন, একই দিনে দুটি ভোটে ভোটার বিভ্রান্ত হতে পারেন। এটি অস্বীকার করা যায় না। তবে এর সমাধানও রয়েছে। গণভোটের ব্যালটপত্র বা প্রশ্নকে সহজ, স্পষ্ট ও একবাক্যে রাখা; ভোটার শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা; এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আগেভাগেই প্রশিক্ষণ ও প্রচারণা চালানো। যথাযথ প্রস্তুতি থাকলে এই ঝুঁকি কার্যত নেই বললেই চলে।
গণভোট কোনো রাজনৈতিক বিলাসিতা নয়, এটি জনগণের ইচ্ছার সরাসরি প্রতিফলন। নির্বাচন যেমন প্রতিনিধিত্বের প্রতীক, গণভোট তেমনি নীতিগত সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এই দুইকে একত্র করলে জনগণ একবারেই তাদের প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রীয় নীতি- উভয় বিষয়ে রায় দিতে পারে।