বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০২৪ সালের জুলাই গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদলগুলোর অস্তিত্ববিহীন বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছিল। দীর্ঘদিনের বিএনপি জোট ও আওয়ামী লীগ জোট এই দুইধারার রাজনীতির বাইরে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে বেশিরভাগ উদীয়মান তরুণ সমাজ যখন নতুন নেতৃত্বের মুখ খুঁজছিল, সেই মুহূর্তে এদেশের মানুষের মন জয় করে উদীয়মান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন নাহিদ ইসলাম—এক তরুণ, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে জনমনে আশার আলো জ্বালিয়েছিলেন। আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা ও নেতা হিসেবে নাহিদ ইসলামের নাম উঠে এসেছিলো প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সেই নেতৃত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আন্দোলনের আগুন থেকে রাজনীতির মঞ্চে এসে তিনি “জনতার কণ্ঠস্বর” থেকে ধীরে ধীরে “প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা” হয়ে উঠেছেন। এই পরিবর্তনই আজ তার রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে। বছর না পেরুতেই সেই আলোকিত নাম, সেই নেতৃত্ব, সেই জনসমর্থন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।
নাহিদ ইসলামের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল “টাইমিং”এর ভুল। অর্থাৎ, যখন দেশব্যাপী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে, দেশের মানুষ নাহিদের মাঝে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল ঠিক তখনই তিনি জনগণের মনের ভাষা না বুঝে ক্ষমতার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকটা ভুল করে তাড়াহুড়ো করেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন।
সরকারবিরোধী তরুণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যদি বাইরের প্ল্যাটফর্মে থেকে জনতার কণ্ঠস্বর বজায় রাখতেন, আজ তিনি হয়তোবা বিএনপির প্রধান জনাব তারেক রহমান কিংবা জামায়াতের প্রধান ডা. শফিকুর রহমানের সাথে প্রতিযোগিতা করার মত বাংলাদেশের একজন গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেতৃত্ব হতে পারতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের অংশ হয়ে পড়ায় তিনি আন্দোলনের মূল জনভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।
জনতার প্রত্যাশা ছিল নাহিদ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন, সরকারকে বাইরে থেকে নীতিগত, আদর্শগত জায়গা থেকে জুলাই আন্দোলন এর মত অন্যায় বা দেশবিরোধী যেকোনো ইস্যু তে চাপ দেবেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতার ভেতরে চলে গিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে জনতার বিশ্বাস হারালেন।
নাহিদ ইসলামের উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতা গ্রহনের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগিতে তার ব্যক্তিত্বের তিনটি ক্ষতি হলো—আন্দোলনের সহযোদ্ধারা এবং নাহিদ সমর্থক তরুণরা হতাশ হলো; অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং বড় দলগুলো যেমন বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী ও নাহিদ বিরোধীরা তাঁকে ‘বিক্রি হয়ে যাওয়া তরুণ নেতা’ হিসেবে আখ্যা দিল; আর নাহিদ নিজেই পড়ে গেলেন পরিচয় সংকটে—তিনি কি সরকারের অংশ, সরকারপন্থী, বিরোধী পক্ষ, নাকি নাগরিক রাজনীতির প্রতিনিধি। এই চতুর্মুখী টানাপোড়েনে তিনি আসলে তার মূল পরিচয় হারিয়ে ফেললেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে “বিশ্বাসযোগ্যতা” একবার হারালে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। নাহিদের ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটেছে। আন্দোলনের নৈতিক শক্তি তিনি রক্ষা করতে পারেননি। ফলে তার নিজ নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) নৈতিক সংকটে পড়েছে।
২০২৫ সালের মার্চে আত্মপ্রকাশের সময় এনসিপি নিজেদের ঘোষণা দিয়েছিল “বাইনারি রাজনীতি” মানে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ এই দুই ধারার বাইরে একটি নতুন নাগরিক ধারার, নতুন চেতনার জাতীয় রাজনীতি গড়ার দল হিসেবে । কিন্তু, বাস্তবে দলটি এখনো কাঠামোগতভাবে, পরিকল্পনাগতভাবে এবং নেতৃত্বগত দিক থেকে বড় রাজনৈতিক শক্তির দলগুলোর তুলনায় সবদিক থেকেই দুর্বল অবস্থানে।
এনসিপির এখনো মূল দল কিংবা সহযোগী সংগঠন যেমন: যুব, ছাত্র, শ্রমিক, মহিলা, পেশাজীবি ইত্যাদি মাঠপর্যায়ে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড ভিত্তিক কোনো শক্তিশালী কমিটি দাঁড়ায়নি। দলটি এখনো রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক, বড় কয়েকটি শহরমুখী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক রয়ে গেছে। ‘নাগরিক রাজনীতি’র কথা বললেও শিক্ষা, চিকিৎসা, সমাজ সংস্কার, অর্থনীতি, দুর্নীতি দমন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার পুণর্বিন্যাশ কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ইস্যুগুলোতে স্পষ্ট রোডম্যাপ দেয়নি।
দলটি নাহিদ ইসলামের ও অল্প কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সিদ্ধান্ত এবং ভাবমূর্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে বিকল্প প্রধান নেতৃত্ব কিংবা সহযোগী বা সমন্বয়ক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি বা গড়ে তোলেনি বলা যায়। আর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে মিডিয়ার সূত্রমতে এনসিপির জাতীয় অভ্যন্তরীণ আওয়ামী লীগ বিরোধী বলয়, ভারত বিদ্বেষ এবং বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা করার রাজনীতিই এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী দলটি আন্দোলনের ধারাবাহিক চেতনা ধারণ করছে না বরং কেন্দ্রীয় কতিপয় নেতার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই প্রতীয়মান হচ্ছে মাত্র।
নাহিদ ইসলাম বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নিবন্ধন হারানো আওয়ামী লীগ এর রাজনীতিকে বারবার “অতীতনির্ভর ও ব্যর্থ রাজনীতি” বলেছেন। এতে তিনি নিজেকে স্পষ্টভাবে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক চড়াই উৎরাই পেরোনো বড় রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছেন।
তবে এই মুহূর্তের মাঠের বাস্তবতায় বিএনপির এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া আগামী দিনগুলোতে এনসিপির একার পক্ষে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির ভিত্তি মজবুত করা কঠিন। এনসিপি অবশ্য মাঠের রাজনৈতিক কথাবার্তায় কিংবা মিডিয়ার সামনে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে উত্তপ্ত বক্তব্য প্রদান করলেও বিশ্বস্ত সূত্রগুলো থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এনসিপি নিজেদের আসন ভাগাভাগি নিয়ে গোপনে বিএনপির সাথে জোট গঠনের জন্য জোরেশোরেই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে এনসিপি ও জামায়াতের নানান রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জামায়াতকে এনসিপির মিত্র হিসেবে এবং এনসিপিকে অনেকেই জামায়াতের বি টিম হিসেবে মনে করলেও এনসিপি আগামী নির্বাচেন জামায়াতের সাথে জোট করতে রাজি নয়, এটি নীতিগতভাবে তাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্যে পরিস্কার। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এনসিপির তুলনায় জামায়াতের সংগঠন শক্তিশালী, কাঠামোগত অবস্থান মজবুত এবং দলটির জুলাই অভ্যুত্থান এর ভুমিকাও অনস্বীকার্য। ২০২৬ সালের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের মাঠে জামায়াতের সাথে এনসিপির লড়াই চালিয়ে যাবার সাংগঠনিক সামর্থ্য দেখা যাচ্ছে না।
উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের অংশ হয়ে এবং পরে সরে আসায় নাহিদ ইসলামের অবস্থান এখন জাতির নিকট অস্পষ্ট। তিনি সরকারের সরাসরি অংশ নন, পুরোপুরি সরকারের বিরোধী নন, আবার ক্ষমতাসীন বলয়ের অংশও নন। এই দ্ব্যর্থতা এনসিপিকে রাজনৈতিকভাবে অপরিচিত এবং শুরুর তুলনায় কিছুটা দুর্বল “তৃতীয় শক্তি” বানিয়ে ফেলেছে। দলটি এখনো জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ, দলটি আসলে কার বিকল্প? আওয়ামী লীগ, বিএনপি নাকি জামায়াতে ইসলামীর।
বর্তমানে এনসিপির ভেতরে হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, তাসনিম জারা, সামান্তা ইসলাম ও নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীর মতো নতুন মুখ নেতা হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে দেখা যাচ্ছে।
হাসনাত আবদুল্লাহ এখনো মাঠের নেতা, ভাষায় তীক্ষ্ণ, ত্যাগি, জেদি, স্পষ্টবাদি ও দুর্দান্ত সাহসী। বাংলাদেশের তরুণ ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা এনসিপির অন্যান্য নেতাদের তুলনায় অনেক গুন বাড়ছে। সারজিস আলম সংগঠন গঠনে এবং দলের স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ এক নেতা। উপজেলা থেকে ইউনিয়ন হয়ে গ্রামাঞ্চলে দলকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাসনিম জারা ও সামান্তা ইসলাম দুইজন নারী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে শিক্ষিত তরুণ নারীদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে এবং মাঠ ঘাট চষে বেড়াচ্ছেন।
অন্যদিকে নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীর বক্তব্য, অন্যান্য দলগুলোর প্রতি তীব্র আক্রমনাত্বক সমালোচনা তাকে জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতিতে এইভাবে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে তার নেতৃত্বকে তিনি সীমিত প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, চলমান সমসাময়িক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ ও অন্যান্য ইস্যুতে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্ব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। তার জনপ্রিয়তা কতিপয় তরুণের নিকট ধারণাগত, কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়; আর নাহিদের বিকল্প হিসেবে তার দলেরই মাঠের মুখগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।
নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বের ব্যর্থতা শুধু একজন ব্যক্তির নয়, এটি নতুন প্রজন্মের রাজনীতির পরীক্ষাও বটে। এনসিপি এখন এক ক্রান্তিকালে যেখানে “আন্দোলনের স্বপ্ন” ও “ক্ষমতার বাস্তবতা”র সংঘাত চলছে।
রাজনীতি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসের খেলা। যদি নাহিদ ইসলাম সেই বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারেন—জনতার পাশে থেকে, ক্ষমতার বাইরে থেকে, তবে ইতিহাস তাঁকে আবার সুযোগ দেবে। আর যদি তিনি নিজের বলয়ের রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, তবে এনসিপি হয়তো বাংলাদেশে গন অধিকার পরিষদ এর মত আরেকটি “ভালো সূচনার ব্যর্থ গল্প” হিসেবেই থেকে যাবে।
নাহিদ ইসলাম একসময় ছিলেন “আশার প্রতীক”, এখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন “পরীক্ষার প্রতীক” হয়ে। হাসনাত ও সারজিসের মতো তরুণ নেতারা মাঠে এগিয়ে যাচ্ছেন, আর নাহিদ এখনো নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারছেন না।
রাজনীতি কখনও অপেক্ষা করে না—জনগণ এখন তাদের নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব খুঁজছে। এনসিপি যদি সময়মতো নিজেদের পুনর্গঠন করতে পারে, তবে হয়তো নিবন্ধন হারানো আওয়ামী লীগবিহীন বাংলাদেশ একটি “দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি”-র উত্থান দেখতে পাবে। আর যদি তারা দলীয় সংকীর্ণতা, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতায় ডুবে থাকে, তবে দলটি একসময় ইতিহাসের পাদটীকায় হারিয়ে যাবে—যেভাবে অনেক আন্দোলনের দল অতীতে হারিয়ে গিয়েছে।
নাহিদ ইসলামকে এখন তার আগের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে হলে কতিপয় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। যেমন: জনতার হারানো বিশ্বাস পুনর্গঠন করা জরুরি; সংগঠনকে কেন্দ্র থেকে মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত; তরুণদের বাস্তব সমস্যা (বেকারত্ব, দুর্নীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য) নিয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে; আসন্ন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সরাসরি মাঠে অংশগ্রহণ করে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে উপস্থিতি দেখানো; জুলাই আন্দোলন এর নৈতিক শক্তিকে পুনর্জীবিত করা; নাহিদ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে “নীতিনির্ভরতা” ও “ভোটার বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত” গ্রহণ করা; নিজের সকল ভুল সিদ্ধান্ত এবং বক্তব্য এর আত্মসমালোচনার মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা পুনর্গঠন করা; মিডিয়া কেন্দ্রীক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাইরে বাস্তব রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া।
যদি নাহিদ ইসলাম নিজেকে ‘দলপ্রধান’ নয়, বরং ‘পরামর্শদাতা’ হিসেবে পুনর্গঠন করেন এবং মাঠের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকা হাসনাত, জারা বা সারজিসকে ফন্টলাইনে যুক্ত করেন তাহলে আগামীর রাজনৈতিক মাঠে এনসিপি অবশ্যই আরও তীব্র গতিতে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে আবদ্ধ। একদিকে ১৭ বছর পর ক্ষমতার কাছাকাছি আসা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো, জামায়াতে ইসলামী সমমনা অন্যান্য ইসলামি দলগুলো। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত নিবন্ধন হারানো আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদলগুলো, অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে মিডিয়ায় ও সোস্যাল মিডিয়াতে দৃশ্যমান সাংগঠনিকভাবে দুর্বল কিন্তু জনপ্রিয়তা ও জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী ঐতিহ্যবাহী দল এনসিপি।
এনসিপিকে আগামীর রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে এই ধারাগুলোর বাইরে একটি বিকল্প জনমুখী রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। দলটি যদি সেই সুযোগ তৈরি করতে পারে, যদি তারা নেতৃত্ব ও নীতিতে স্পষ্ট পরিবর্তন আনতে পারে তাহলে হয়তো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটা বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখতে পারে।
সর্বোপরি, আশার জায়গা একটাই। দেশের মধ্যবিত্ত ও সাধারণ জনগণের নিকট এনসিপি এখনো “বিকল্প রাজনীতির ধারণা” বহন করছে। যদি দলটি দ্রুত কাঠামোগত পরিবর্তন, নেতৃত্ব হস্তান্তর ও আদর্শিক স্বচ্ছতা আনতে পারে, তবে আগামী নির্বাচেন এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বাস্তব ধারার দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠতে পারে। কারণ, তরুণ প্রজন্মের মাঝে “বিকল্প রাজনীতির আশার আলো” হিসেবে অন্যান্য বড় দলের তুলনায় এনসিপি এখনো টিকে আছে। এর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো—দলটির মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও মাঠকেন্দ্রিক উভয় ধরনের নেতৃত্ব রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি ব্যাপক, এবং রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর বিশ্লেষণমূলক উপস্থাপন এনসিপিকে সচেতন নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে।
তবে দলটি এখনো স্পষ্ট আদর্শিক অবস্থান নির্ধারণে ব্যর্থ। রাজনীতির মাঠে প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত বদল করা যেমন: কখনো ঘোর সরকারবিরোধী, কখনো সরকারঘেঁষা, কখনো বিএনপি বিরোধী আবার কখনো জামায়াত বিরোধিতার আচরণ জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধীর গতির পট পরিবর্তন এবং নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীর মত গ্রহনীযোগ্য ও অগ্রহনীযোগ্য বক্তব্য প্রদানের মত রাজনীতি তাদের সাথে অভ্যুত্থান সময়কালীন দলগুলোর দলীয় ঐক্য ভাঙছে।
এছাড়াও সুস্পষ্ট করে বললে দলটির জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও নির্বাচনী প্রস্তুতি দুর্বল। মাঠ পর্যায়ে টেকসই সংগঠন না গড়লে, দলটি শিগগিরই শুধুমাত্র “মিডিয়ার মুখোমুখি শুধুমাত্র সোস্যাল মিডিয়ার দল” হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং এনসিপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দ্রুত নেতৃত্বের অবস্থান পরিবর্তন অথবা রূপান্তরের ওপর। আমাদের দেশের চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অতিমাত্রায় ভদ্র প্রকৃতির নাহিদ ইসলাম, অতিমাত্রায় অনশনব্রত শান্ত চরিত্রের আকতার হোসেন কিংবা অতিবচন এর নাসিরুদ্দিনের মধ্যে প্রতিপক্ষের সাথে ভোটের মাঠে লড়াই চালিয়ে যাবার মত শক্তিশালী মনোভাব কম। তুলনামূলকভাবে হাসনাত, জারা ও সারজিসের সাহস, দৃঢ়তা, মনোবল ও উপস্থাপনা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বেশি উপযুক্ত। যদি নাহিদ ইসলাম তার নেতৃত্বের ধরন রুপান্তর করে হাসনাত আবদুল্লাহ বা সারজিস আলমের মতো বাস্তববাদী, মাঠকেন্দ্রিক, সাহসী, দৃঢ়চেতা, আক্রমনাত্মক, বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এবং নীতিনিষ্ঠ হতে পারেন অথবা তাদেরকে প্রধান নেতৃত্বে আনা যায়, তবে দলটি জাতীয় রাজনীতিতে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারবে।
আওয়ামী লীগ এর দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল করার পর থেকে বিএনপি ও জামায়াতের তুলনায় এনসিপি এখনো তুলনামূলকভাবে ইস্যুভিত্তিক, জনকল্যাণমুখী এবং সমাজভিত্তিক রাজনীতি করছে—যা দলটিকে নতুন প্রজন্মের কাছে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। কিন্তু এই পরিচিতি টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার দৃঢ় নেতৃত্ব, স্পষ্ট আদর্শ এবং রাজনৈতিক সাহস। অতীতের ভুল ও বর্তমানের বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও এনসিপি’র সামনে সম্ভাবনার দরজা খোলা আছে। যদি দলটি এখনই নেতৃত্বে পুনর্বিন্যাস, সাংগঠনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনমুখীনীতি গ্রহণ করে, তাহলে আসন্ন ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী “দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তি” হিসেবে আবির্ভূত হতে পারার জোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ডীন ও চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
কেকে/ আরআই