বাংলাদেশের এ মুহূর্তে দুটি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। দুটি শব্দই ‘ত’ বর্ণ দিয়ে শুরু। আপনাদেরকে ধাঁধায় ফেলব না, তৃণমূল ও ত্যাগী। শব্দ দুটি শুনলেই মন ভরে যায় আর এই শব্দের পাশে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বেমানান মনে হয়, একেবারেই বেমানান। যেমন প্রেমিক, স্বামী, চাকরিজীবী, ছাত্র বা শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝতে একটু সমস্যা হতে পারে। বুঝিয়ে বলছি যেমন তৃণমূল ও ত্যাগী প্রেমিক, তৃণমূল ও ত্যাগী স্বামী, তৃণমূল ও ত্যাগী চাকরিজীবী, তৃণমূল ও ত্যাগী ছাত্র, তৃণমূল ও ত্যাগী শিক্ষক, তৃণমূল ও ত্যাগী ইমাম। বাক্যগুলো সঠিক হলেও বেমানান মনে হবে। আবার এমন একটি শব্দ আছে বেঠিক হলেও মানানসই মনে হবে। সেই শব্দটি হলো ‘নেতা’। তৃণমূল ও ত্যাগী নেতা। বাক্যটি পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে না? একেবারেই পরিপূর্ণ। শব্দ তিনটি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে আশান্বিত করেছিল অতীতে, জনগণ আশান্বিত হচ্ছে বর্তমানে এবং আশান্বিত হবে ভবিষ্যতেও।
ত্যাগ নিয়ে কথা বলা খুবই রিস্কি। কেন রিস্কি শব্দটি ব্যবহার করলাম তা না বললে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। আমার অনেক পরিচিতজন আছেন যারা গত পনেরো বছর নীরবে চাকরি করে গেছেন, চাকরির সব সুবিধা ভোগ করেছেন তারপরও তারা ত্যাগী। তাদের যুক্তিগত পনেরো বছর দল করতে পারেনি, দলের কোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারেনি, জিয়ার মাজারে যেতে পারেনি। দল না করতে পারার ত্যাগ রয়েছে তাদের, দলের কোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ না করতে পারার ত্যাগ রয়েছে তাদের, জিয়ার মাজারে যেতে না পারার ত্যাগ রয়েছে তাদের, তাদের অন্তর জ¦লে-পুড়ে ছারখার হয়েছে, কেউই টের পায় নাই, ওনাদের এই ত্যাগ সতেরো বছর, সবচেয়ে বেশি ত্যাগ। এই ত্যাগটিকে মোটেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এ রকম যে কত ত্যাগ আছে আমি জানি না, আমার জানাও নেই। কে যে ত্যাগী আর কে যে ত্যাগী না তা আমার জন্য এ মুহূর্তে বলা কঠিন। যার জন্যই ত্যাগ নিয়ে কথা বলা খুবই রিস্কি। শহর, মহানগর বা রাজধানী থেকে ত্যাগী নেতা খুঁজে বের করা যত কঠিন, তৃণমূল থেকে ত্যাগী নেতা নির্ণয়ে জটিলতা হবে না বা হচ্ছে না।
তৃণমূল নেতাদের নিয়ে লিখতে চাই। মাঠপর্যায়ের নেতাকেই আমরা তৃণমূল নেতা বলি। বাংলাদেশের এমনকি কোনো গ্রাম আছে যে, গ্রামে দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয় নাই, দুচার মাস জেল খাটে নাই? নেই একটিও নেই। তৃণমূল থেকে নেতা নির্ণয়ে জটিলতা হবে না বা হচ্ছে না। তৃণমূল ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের বিষয়টি সাড়া ফেলেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সঠিক সিদ্ধান্ত ও সময় উপযোগী ইন্ডিকেটর। জাতীয় নির্বাচনে এই ইনডিকেটর একটি অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করবে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। এখন আসি আমার মূল আলোচনায়।
৩১ দফার সবগুলোই জনগণের জন্যই প্রণীত হয়েছে, তবে ২৭ নম্বর দফার সঙ্গে তৃণমূল নামক শব্দটি সরাসরি সম্পৃক্ত। এই দফার প্রভাব আমাদের জীবনে প্রতিদিন পরবে, প্রতি বেলায় পরবে। এই দফায় বলা হয়েছে, ‘কৃষকের উৎপাদন ও বিপণন সুরক্ষা দিয়ে কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা’। এসবের জন্য যেসব তথ্য প্রয়োজন সেসব তথ্য কি তৃণমূল নেতাদের কাছে আছে? উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব কিন্তু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চাহিদার ও সরবরাহ পরিমাণ পরিসংখনের ওপর নির্ভর করা গেলেও উৎপাদনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উৎপাদনের পরিমাণ গরমিল হলেই দাম কমবেশি হতে পারে। আমরা প্রশাসনিক (সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান) ভাবে উৎপাদনের তথ্যের ওপর নির্ভর করি, রাজনৈতিক ভাবে উৎপাদনের তথ্যে সংগ্রহ করতে পারলেই কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সহজ হবে। রাজনৈতিক ভাবে উৎপাদনের তথ্যে আবার কি? তৃণমূল নেতারা কি জানেন গ্রামভিত্তিক কৃযি জমির পরিমাণ, ধান-আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন অন্যান্য কৃষিপণ্য, আম-কাঁঠাল অন্যান্য ফলমূল উৎপাদনের পরিমাণ কত? পুকুরের সংখ্যা ও মাছ উৎপাদনের পরিমাণ কত?
গ্রামভিত্তিক, ইউনিয়নভিত্তিক, থানাভিত্তিক, জেলাভিত্তিক, বিভগভিত্তিক আবাদি জমির পরিমাণ কত? এসব জানা না থাকলে উৎপাদনের সঠিক হিসাব পাওয়া যাবে না। এসব তথ্য ছাড়া তৃণমূল নেতা হওয়া যায়? ইউনিয়নের নেতাদের জানতে হবে তার ইউনিয়নের উৎপাদন ক্ষমতা, থানার নেতাদের জানতে হবে তার থানার উৎপাদন ক্ষমতা, জেলার নেতাদের জানতে হবে তার জেলা উৎপাদন ক্ষমতা, বিভাগের নেতাদের জানতে হবে তার বিভাগের উৎপাদন ক্ষমতা। এটিই হোক তৃণমূল নেতা হওয়ার একটি শক্তিশালী ও বাধ্যতামূলক উপাদান। তাহলেই গ্রামভিত্তিক কৃষক, কৃষিপণ্য, উৎপাদন ক্ষমতার ডেটাবেজ তৈরি করা সম্ভব হবে। তা থেকে সমগ্র দেশের কৃষিপণ্যের ডেটাবেজ তৈরি হবে। যা সরকারি তথ্যের সঙ্গে যাচাইয়ে এবং কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি বা রপ্তানির পূর্ব প্রস্তুতি থাকবে। হুট করে কৃষিপণ্যের দাম কম-বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
অন্যদিকে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে পণ্যের পচন রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রচার করতে হবে, সেটি হতে পারে সেন্টার পয়েন্টে হিমাগার তৈরি বা রপ্তানির জন্য নিকটস্থ বিমানবন্দরকে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা। জনগণ কি চায় এটা তৃণমূল নেতারাই জানবে বেশি, তারা জানে জনগণ দুবেলা পেট ভরে খেতে চায়, তারা চায় ধান-আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-মরিচের দাম যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে আর একটি তাদের চাহিদা রয়েছে, সেটি কি? তাদের নেতাদের কথা ও কাজের মিল। তৃণমূল নেতারা এটাও জানেন যে, সকাল-সন্ধ্যায় চায়ের টং দোকানে তাদের নেতার সুনাম শুনতে ও বলতে জনগণ পছন্দ করে। আর এই চায়ের টং দোকান রয়েছে প্রতিটি গ্রামে-গ্রামে, সেখানে আলোচ্য বিষয় ধান-আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-মরিচের দাম। এখানে কিন্তু সংস্কার, সংবিধান নিয়ে আলোচনা হয় না। আর যদিও হয়, তা শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে বিষয়টি তাও নয় বরং আপনার চোখই থাকবে না। সাধারণ মানুষ অতীত নিয়ে খুব একটা ভাবে না, ভাবলেও তারা ধান-চাল আলুর দাম নিয়েই ভাবে। এক্ষেত্রে অতীত দিয়েই মূল্যায়ন করে থাকে। সেই সঙ্গে মানুষ ভাবে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিরোধী দল সবসময় বর্তমান নিয়ে থাকবে, এরা বর্তমানকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করবে। যে কোনো সরকারের বর্তমানকে সফলতার সঙ্গে চলতে হলে ধান-আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুন-মরিচের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার বিকল্প নেই।
মানুষ সবকিছুই তথ্যভিত্তিক চায়। পরিসংখ্যান মানুষ মনে রাখে। সংখ্যা মানুষের মনে গেঁথে থাকে। দফার স্বল্প মেয়াদি-মধ্যম মেয়াদি-দীর্ঘমেয়াদি পরিসংখ্যান-ভিত্তিক হতে হবে। তৃণমূল নেতাদের নিকট যদি মোট উৎপাদনের তথ্য না থাকে, তাহলে তো তৃণমূলের নেতাকর্মী সমর্থকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা কঠিন হবে, তারা ব্যর্থ হবেন। তৃণমূল ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করার সার্থকতা থাকবে না।
লেখক: ভাইস চেয়ারম্যান, ঢাকা সেন্টার, আইইবি, ঢাকা
কেকে/ এমএ