একের পর এক ভরাডুবি। প্রথমে ডাকসু, এরপর জাকসু-চাকসু ও রাকসু। চার বিশ্ববিদ্যালয়েই লজ্জাজনক ফল পেয়েছে বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের প্রার্থীরা। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদে ছাত্রদলের এ ভূমিধস পরাজয়ের নেপথ্যে কারণ নিয়ে এখন চলছে বহুরৈখিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারাও এ লজ্জাজনক হারের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। যতগুলো কারণ ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে ছাত্রদলের গ্রুপিং।
জানা যায়, দুষ্টুচক্রের গ্রুপিংয়ে কারণে সারা দেশেই এলোমেলো হয়ে আছে বিএনপির ‘ভ্যানগার্ড’খ্যাত ছাত্রদল। বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল নিজস্ব বলয় তৈরি করতে গিয়ে ছাত্রদলকে এক ধরনের জিম্মি করে রেখেছেন বলেও অভিযোগ আছে। তবে এই নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে নারাজ। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বকুলের হাতে জিম্মি হওয়ার প্রতিফলনই হচ্ছে সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল।
ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। এর মূল কারণ হচ্ছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল তারা যোগ্যদের নেতৃত্বে না এনে নিজ গ্রুপের ছেলেদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়েছেন। ফলে তৈরি হয় গ্রুপিং, বিভক্ত হয় ছাত্রদল। আর এ বিশৃঙ্খলার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন বিএনপি ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল এমন অভিযোগ নেতাকর্মীদের। তাদের দাবি, এ গ্রুপিংয়ের রাজনীতির কারণে সংগঠনটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের একাধিক নেতা জানান, সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডাকসু নির্বাচনে দলীয় ব্যানারে যেতে চাননি। কারণ দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বিএনপির ক্ষমতার বাইরে ছিল। এ ছাড়া ছাত্রদলও ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারেনি। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব আছে। এসব কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ ছিল। ঢাবি সাদা দলের নেতারাও ডাকসু নির্বাচনের না যাওয়ার পক্ষে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে মতামত দেন। সব উপেক্ষা করে এক বকুলের সিদ্ধান্তে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয় ছাত্রদল। এখানেই শেষ নয়, পছন্দমতো প্রার্থী দিতে না পারায় নির্বাচনের সময় তার ভূমিকাও ছিল ‘প্রশ্নবিদ্ধ’।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, বকুলের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসিরের নাম শোনা যায়। নাসিরকে ডাকসুতে প্রার্থী করতে না পেরে তিনি ক্ষুব্ধ হন। যে কারণে তিনি নির্বাচনের সময় নিষ্ক্রিয় থাকেন এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য হাসপাতলে ভর্তি হন। এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দেশের চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) ২৮ পদের ২৫টিতে শিবির জয়ী হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদদে (জাকসু) ২৫ পদের ২০টিতেই শিবির জয়ী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (চাকসু) ২৬ পদের ২৪টিতেই শিবির। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে মোট ২৩টি পদের ২০টিতেই জিতেছে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’। একেবারে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অনেকে বলছেন ভূমিধস বিজয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন শিবিরের এ বিস্ময়কর উত্থান। আর শিবিরকেই কেন বেছে নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। এ বিজয়ের নেপথ্য কারণে হিসেবে বলা হচ্ছে, পট পরিবর্তনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত গত ১৬ বছর শাসন করে আসা ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ। এ সুযোগে গোপনে ফাঁকা ক্যাম্পাসে নানা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে শিবির। সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা। আর এতেই হলে হলে নিজেদের অবস্থান শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছে। শিক্ষার্থীদের উপকারে আসে, করেছে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড। হলের পানির সমস্যা দূর করতে বসিয়েছে পানির ট্যাংক। ধর্মভিরু শিক্ষার্থীদের টেনে নিয়েছে কাছে।
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় শিবিরের রয়েছে ফেসবুক গ্রুপ। নানা নামে রয়েছে ফেক আইডি। এসব গ্রুপ ও আইডির রয়েছে লাখ লাখ ফলোয়ার। যে কোনো ইস্যুতে নেতিবাচক প্রচারণায় সহজেই বিরোধীদের ঘায়েল করেছে তারা। এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল ছাত্রদলসহ প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো।
তবে শিবিরের কৌশলের বিপরীতে পাল্টা কোনো কৌশলই নিতে পারেনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল। অনেকটা স্লোগাননির্ভর সংগঠনটির রাজনীতি। ওমুক ভাই-তমুক ভাই সিন্ডিকেটে আবদ্ধ। কমিটিতে মেধাবীদের জায়গা নেই। তার ওপর গত ১৭ বছর ঢাবি ক্যাম্পাসেই প্রবেশ করতে পারেনি ছাত্রদল।
ঢাবি, জাবি, চবি ও রাবির কোনো হলেই কার্যক্রম চালাতে পারেনি সংগঠনটি। কমিটির বাইরে নেই নতুন রিক্রুট। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখার কোনো জ্যেষ্ঠ নেতার ছাত্রত্ব নেই। কনিষ্ঠ অপরিচিত মুখদের প্রার্থীদের করা হয়েছে। পুরো প্যানেল দিতে পারেনি অধিকাংশ হলে। তার ওপরে ডাকসু নির্বাচনের আগে হল কমিটি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়ে সংগঠনটি। তা ছাড়া গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সাধারণ ছাত্রদের মনস্তত্ত্বে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটি বিবেচনা করা হয়নি। শীর্ষ পদে যে তিনজন ভালো ভোট পেয়েছেন তাও নিজের ক্যারিশমায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা ভোট দিয়েছেন তারা যে সবাই শিবিরের আদর্শ চিন্তা করে ভোট দিয়েছেন তা নয়, তারা ক্যাম্পাসে দখলদারীর ছাত্ররাজনীতির আশঙ্কা থেকে ভোট দিয়েছেন। কারণ তারা অতীতে অনেক ছাত্র সংগঠনের দখলদারত্বের রাজনীতি দেখেছেন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বিবেচনায় শিবিরের রেকর্ড নেই। আর ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তাদের বড় একটা ভূমিকা ছিল।
তারা মনে করেছে, ছাত্রদল জিতলে তারা ছাত্রলীগের মতোই ক্যাম্পাসে আধিপত্য ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। গেস্টরুম কালচার তৈরি করবে। সাধারণ ছাত্ররা নির্যাতনের শিকার হবে। সেই বিবেচনায় ছাত্রশিবিরের প্রার্থীদের ইমেজ ভালো ছিল। আর ছাত্রদলের মধ্যে একট দাম্ভিক ভাব চলে এসেছে। যা ছাত্ররা খেয়াল করেছে। ছাত্রদল জিতলে তারাও ওই রকম হবে। তারও একটা জবাব দিয়েছে তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরকে মোকাবিলা করতে হলে রাজনীতির কৌশল বদলাতে হবে ছাত্রদলকে। পুরোনো চিরাচরিত রাজনীতির ধারার পরিবর্তে বাস্তবভিত্তিক নতুন ধারার রাজনীতি করতে হবে। জেন-জি প্রজন্মের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যৎ রাজনীতির কৌশল ঠিক করতে হবে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটিকে।
জাকসু নির্বাচনের ফলের পরদিন নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্কাইপি মিটিংয়ে সাত নেতাকে ডাকেন তারেক রহমান। মিটিংয়ে অংশ নেন, বিএনপি ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন এবং ছাত্রদলের সুপার ফাইভের নেতারা।
বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা বলেন, ওই বৈঠকের পরই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবারো সেই ছাত্রবিষয়ক সম্পাদাকর হাতেই জিম্মি সংগঠন। নানা অজুহাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন কমিটি গঠন না করার অনুরোধ জানান বকুল।
অপর এক নেতা জানান, বিএনপির ছাত্রবিষয়ক পদে আপাতত কাউকে দায়িত্বে না রেখে নিজেই ছাত্রদলকে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে কাজ করবেন তারেক রহমান। এ ছাড়া শিগগির ছাত্রদলে নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। তার মুঠোফোন নাম্বারে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো প্রতিউত্তর করেননি।
কেকে/ এমএস