বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিরোধী রাজনৈতিকদের নানাভাবে নরজদারিতে রাখা হতো। তাদের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড করা হতো। এমনকি মোবাইল ফোনসহ যে কোনো ডিভাইসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া হতো। আর এর জন্য ইসরায়েল থেকে আড়িপাতার যন্ত্র কিনত ফ্যাসিস্ট সরকার। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আশা করা হয়েছিল, নাগরিকদের সুরক্ষায় নতুন সরকার মনোযোগী হবে। সেই সঙ্গে নজরদারিমুক্ত ভাবে মানুষ তাদের মত প্রকাশ করতে পারবে। তবে সম্প্রতি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ারের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নতুন করে আশঙ্কা জন্ম দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, সরকার ফোনে আড়িপাতার সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও তা বেশ গোপনে।
গতকাল শুক্রবার জুলকারনাই ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘বিভিন্ন অ্যানক্রিপডেট অ্যাপে (হোয়াটসঅ্যাপস, টেলিগ্রাম বিটকয়েন ইত্যাদি) কমিউনিকেশনের ওপর নজরদারি করার টেকনোলজি (প্রযুক্তি) খোঁজ করছেন বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) প্রধান জনাব গোলাম রসূল। নজরদারির সরঞ্জাম সরবরাহ করে, এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য জানিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন যে, বেশ কিছু দিন ধরেই lawful interception solution এর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এসবি প্রধান ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দু’জন ব্যক্তি, মূলত স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সক্ষমতা বৃদ্ধি তাদের উদ্দেশ্য।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘এরই ধারাবাহিকতায় দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘DevsZone’-এর অর্থায়নে আজ (শুক্রবার) রাতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন এসবি প্রধান গোলাম রসূল (পোস্টে তিনি এ সংক্রান্ত নথি যুক্ত করেন)।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের আদেশ (জিও) সাধারণত অনলাইনে প্রকাশ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে গোলাম রসূল সাহেবের এই জিওটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাইটে পাওয়া যাচ্ছে না, অবশ্য একই দিনে ইস্যু করা অন্য সব জিওই সাইটটিতে আছে। তবে, সংযুক্তি ২ অনুযায়ী (২৩ মার্চ ২০২৫ এর চিঠি) ঠিকাদার/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে ‘অবশ্যই বিদেশ ভ্রমণ পরিহার’ এর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে ৭ অক্টোবর ২০২৫-এর এই জিও অনুযায়ী দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘DevsZone’ এর অর্থায়নে যুক্তরাজ্য সফরের আয়োজন কি সাংঘর্ষিক নয়?’
জুলকারনাইন জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি এসবি প্রধান গোলাম রসূলের সঙ্গে কথা বলেছেন। পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে জানতে আমি সরাসরি জনাব গোলাম রাসূলের সঙ্গে কথা বলি, তিনি যা মন্তব্য করেছেন, তা তুলে ধরা হলো- নজরদারি সরঞ্জাম নয়, ভিআইপি-ভিভিআইপি নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ এক্স-রে ইকুইপমেন্ট সশরীরে দেখতে ও এ সবের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে, তিনি গত রাতে যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন। নজরদারি সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়টি কল্পনাপ্রসূত বলে তিনি দাবি করেন। দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘DevsZone’-এর অর্থায়নেই সফরটি হচ্ছে এটা তিনি নিশ্চিত করেছেন। এবং উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অনুমোদন নিয়েই উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটির অর্থায়নে সফরটি আয়োজন করা হয়েছে।’
এখনো বন্ধ হয়নি আড়িপাতার প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তি বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এ গবেষণায় উঠে আসে, ২০১৫ থেকে ২০২৫, এই ১০ বছরে নজরদারি আর স্পাইওয়্যার কেনায় বাংলাদেশ খরচ করছে ১৯ কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে যা দুই হাজার কোটির বেশি। গবেষণায় বলা হয়, নজরদারি কেবল কল রেকর্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং যেকোনো ডিভাইসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল।
এ ছাড়া ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আড়িপাতার সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল, যা থেকে বোঝা যায় ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতেই এসব নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।
তবে হাসিনা সরকার পতনের পরও এমন কিছু ভিডিও বা আলাপচারিতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে, যার পেছনে শোনা যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতার গুঞ্জন। কারণ এখনো বহাল তবিয়তেই আছে নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান ও সরঞ্জাম। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সেসব দিয়েই জনসাধারণের ওপর আড়িপাতার সুযোগ থেকে যাচ্ছে কি না।
নজরদারি ও আড়িপাতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠা সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার- এনটিএমসি এখনো চালু রয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এনটিএমসি বন্ধের সুপারিশ করা হলেও এখনো চালু আছে সংস্থাটি। জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনেও সংস্থাটিকে বিলুপ্ত করার এবং জনগণের ওপর বেআইনি নজরদারি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছিল।
যেভাবে দেশব্যাপী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পুলিশ, র্যাব ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) যৌথভাবে এক হাজার ১৩৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যের নজরদারি সরঞ্জাম কেনে। অন্যদিকে এনটিএমসি তৈরি করেছিল ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইএলআইএস) নামে দেশব্যাপীবিস্তৃত এক পরিকাঠামো, যা সব নাগরিকের ইন্টারনেট ও টেলিকমিউনিকেশন ট্রাফিকের বিপুল তথ্য, অনায়াসেই নজরদারি, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণ করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে তাৎক্ষণিক বা রিয়েল-টাইম কেন্দ্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা।
অন্যদিকে, র্যাব ও পুলিশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিনেছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক আড়িপাতা যন্ত্র। র্যাবের জন্য কেনা হয়েছে মোবাইল ফোন ও যানবাহনে বসানো যায় এমন জ্যামার, ব্যাগে বহনযোগ্য মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর পরিচয় শনাক্তকরণে আইএমএসআই ক্যাচার (IMSI Catcher) এবং মোবাইল যোগাযোগ বিশ্লেষণ সরঞ্জাম- যেগুলোর মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল কার্যক্রমের ওপর নজরদারি চালানো হতো অথবা মোবাইল ফোনের সিগন্যাল বন্ধ করে দেওয়া হতো।
পুলিশ তৈরি করেছিল আরো বিস্তৃত এবং সূক্ষ্ম নজরদারি সক্ষমতা। তাদের ছিল উন্নতমানের আইএমএসআই ক্যাচার, জিপিএস ট্র্যাকার, স্যাটেলাইট যোগাযোগ বিশ্লেষণযন্ত্র, কথোপকথনে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত পদ্ধতি এবং ‘ম্যান-ইন-দ্য-মিডল’ টুল যা এনক্রিপ্টেড যোগাযোগে ঢুকে পড়তে এবং স্পাইওয়্যার প্রবেশ করাতে সক্ষম।
জানা গেছে, ২০২২ সালের মধ্যেই এনটিএমসি নাগরিকদের দৈনন্দিন যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তি কিনে ফেলে, যেন এসব তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য সহজলভ্য হয়।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইয়ানা টেকনোলজিস এবং প্রতিষ্ঠানটির যুক্তরাজ্যভিত্তিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইয়ানা লিমিটেড এনটিএমসিকে আইএলআইএস পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ১০টি পৃথক সিস্টেমের সমন্বয়ে এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য 'সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ, সংকলন, বিশ্লেষণ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে সরবরাহ করা, যার মাধ্যমে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় থাকা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়।
প্রথম দুটি অংশ হলো মোবাইল ও ডেটা ইন্টারসেপশন সিস্টেম, যা ‘কোনো ব্যক্তির সব ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ’ এবং ‘বাংলাদেশে উৎপত্তি, বাংলাদেশে শেষ কিংবা বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া’ সব ধরনের ডেটা ও ইন্টারনেট যোগাযোগে নজরদারি চালাতে সক্ষম।
তৃতীয় অংশটি হলো একটি বিপুল আকারের ডেটা সংগ্রহ ব্যবস্থা, যা ন্যাশনাল গেটওয়ে ও ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ লেভেল থেকে সব ধরনের ইন্টারনেট যোগাযোগের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। চতুর্থ সিস্টেমের মাধ্যমে সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা একটিমাত্র নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে যে কোনো নেটওয়ার্ক ও অপারেটর ব্যবহারকারী যে কোনো ব্যক্তির সব ধরনের যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ, নজরদারি এবং বিশ্লেষণ করা যায়।
পঞ্চম উপাদানটি ‘ইউনিফায়েড টার্গেট প্রোফাইলিং সিস্টেম’ নামে পরিচিত। এটি নজরদারির আওতায় থাকা সব তথ্য সংকলন, যোগাযোগের ধরন বিশ্লেষণ এবং সময়, স্থান ও যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির ‘সম্পূর্ণ ৩৬০ ডিগ্রি চিত্র’ উপস্থাপন করতে পারে। ষষ্ঠ উপাদানটি হলো কল ডিটেইল রেকর্ড বিশ্লেষণ ব্যবস্থা এবং সপ্তম উপাদানটি জিওলোকেশন সিস্টেম। অষ্টম ও নবম অংশটি হলো এনটিএমসি ভবনের ভেতরে ডিজিটাল কমান্ড সেন্টার এবং সামগ্রিক কার্যক্রম ও ব্যবস্থাপনা। দশম উপাদানটি হলো ‘অ্যাকটিভ ইনট্রুশন সিস্টেম’, যা যে কোনো ডিভাইসে এনক্রিপটেড বা যে কোনো এনকোডিং ব্যবস্থার মধ্যেই আড়ি পেতে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, কারো সহায়তা ছাড়াই কার্যসম্পাদনে সক্ষম এবং ডিভাইসের সব অ্যাপ্লিকেশন, ফাইল ও যোগাযোগের তথ্য প্রকাশ করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অর্থ মূলত যে কোনো ডিভাইসের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সক্ষমতা আছে এই পুরো কাঠামোর।
কেকে/এআর