* বেড-কেবিনের অস্বাভাবিক ভাড়া
* করানো হয় অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা
* বাড়তি বিল নিতে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা
* ছাত্রহত্যার আসামি হয়েও বহাল তবিয়তে আলোক মালিক লোকমান হোসেন
রাজধানীর মিরপুরের আলোক হাসপাতাল। যার স্লোগান হচ্ছে ‘সুস্থ জীবন, সুন্দর পৃথিবী’। রোগীদের দেওয়া হয় স্বল্প খরচে আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসার আশ্বাস। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অসুস্থ নাগরিকদের সেবা নয়, বরং তাদের পকেট কাটাই যেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান লক্ষ্য।
রোগীদের কাছ থেকে অস্বাভাবিক বিল আদায়, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির খরচে অতিরিক্ত চার্জ সব মিলিয়ে সেবার আড়ালে এক ধরনের লুটপাট চলছে এ হাসপাতালটিতে। সিট এবং কেবিন ভাড়ায় চলছে রীতিমতো ডাকাতি এমন অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনরা।
তারা বলছেন, এখানে ভর্তির আগে নানা ধরনের সুবিধা এবং ডিসকাউন্টের কথা বলা হলেও শেষে সে কথা রাখে না কর্তৃপক্ষ। তখন চিকিৎসার চেয়ে টাকার হিসাবই বড় হয়ে দাঁড়ায় এ প্রতিষ্ঠানে। প্রতি মুহূর্তে রোগীর স্বজনদের চাপ প্রয়োগ করা হয় বিল পরিশোধের জন্য। তখন বাধ্য হয়ে বিল পরিশোধ করেন তারা। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ অসুস্থ শরীর নিয়ে এ হাসপাতালে যায় আশার আলো খুঁজতে, কিন্তু ফেরার পথে তাদের কাঁধে যুক্ত হয় ঋণ আর হতাশা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানান, তার ষাটোর্ধ্ব বাবা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বাসায় রেখেই তার চিকিৎসা চলছিল। তবে মাঝে-মাঝে রোগীকে ডাক্তারের চেম্বারে নিতে হতো। বাসা একটু দূরে হওয়ায় ডাক্তার তাকে নিকটস্থ আলোক হাসপাতালে রোগী ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। রোগীর ছেলে মেনে নিলেন চিকিৎসকের পরামর্শ। যোগাযোগ করা হলো আলোক হাসাপাতালে। সেখান থেকে জানানো হলো তাদের কোনো কেবিন ফাঁকা নেই, তবে একটা কেবিন দেওয়া যেতে পারে, সেটার প্রতিদিনের চার্জ আসবে ৯ হাজার টাকা।
রোগীর অবস্থা অতটা জটিল নয়। তাই রোগীর ছেলে জানালেন তারা এত টাকা দিতে পারবেন না। তখন হাসপাতাল থেকে তাকে জানানো হলো, ‘সমস্যা নেই আপনি ভর্তি করান, ফাইনাল বিলের সময় এটা অর্ধেক করে দেওয়া যাবে।’ এ আশ্বাসে রোগী ভর্তি করানো হলো। ছোট্ট একটা কেবিন, একটা এসি দুইটা বেড তার ভাড়া নাকি ৯ হাজার!
রোগীকে সেখানে তিন দিন রাখা হলো। অবস্থার তো কোনো ধরনের উন্নতি হলোই না, এর মাঝে আইসিইউ-সিসিইউ টানাটানি করা হলো। অথচ যেটার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর মাঝে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিল পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হতো স্বজনদের। তিন দিন পর ধরিয়ে দেওয়া হলো এক লাখ ৯০ হাজার টাকার একটা লম্বা বিল। এমনকি কেবিন ভাড়ায় যেটা ডিসকাউন্ট দেওয়ার প্রুতিশ্রুতি ছিল দেওয়া হলো না সেটাও। কোনো উপায় না পেয়ে ধারদেনা করে বিল মিটিয়ে বাবাকে রিলিজ করালেন ভুক্তভোগী।
উত্তরার বাসিন্দা রেজাউল করিমের (ছদ্মনাম) স্ত্রী গত সপ্তাহে জ্বরে আক্রান্ত হন। প্রথমে স্থানীয় ক্লিনিকে গেলে তাকে আলোক হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় ‘তিন দিনের প্যাকেজে সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকায় চিকিৎসা সম্পন্ন হবে।’ কিন্তু ডিসচার্জের দিন হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বিল।
রেজাউল বলেন, ‘আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল হয়েছে। পরে দেখি বিলের মধ্যে আছে একাধিক টেস্ট, যেগুলোর দরকারই পড়েনি। অক্সিজেন সাপোর্টের নামেও আলাদা চার্জ, আবার প্রতিদিন ডাক্তার ভিজিট ফি তিনবার করে কাটা হয়েছে।’ বিলের বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সংক্ষেপে বলেন, ‘এই রেট নির্ধারিত। সিস্টেম থেকে যা আসে, সেটাই দিতে হবে।’
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর একের পর এক অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করানো হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসক উপস্থিত না থেকেও রিপোর্ট তৈরি হয়, শুধু বিল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। এটা আলোক হাসপাতালের অঘোষিত রীতি। রোগী ভর্তি মানেই ‘ল্যাব প্যাকেজ’। পরীক্ষার দরকার আছে কিনা, সে বিচার কেউ করে না।
ওষুধের ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ। হাসপাতালের ভেতরকার ফার্মেসি থেকেই ওষুধ নিতে বাধ্য করা হয় রোগীদের। রোগী ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে গাদা গাদা ওষুধ এনে ঢুকিয়ে রাখা হয় রোগীর ড্রয়ারে। বাইরের দোকানে একই ওষুধ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে পাওয়া গেলেও এখানে মেলে না কমিশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের বড় অংশটাই এখন মুনাফানির্ভর। রোগী এখানে আর মানুষ নয়, ক্রেতা। এই দৃষ্টিভঙ্গিই সবচেয়ে বিপজ্জনক। আলোক হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে বিলের কাঠামো এমনভাবে সাজানো যে, রোগী যত বেশি দিন থাকবে, বিল তত বাড়বে। এই মডেলটা সেবা নয়, বাণিজ্য।
একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, চিকিৎসা মানে শুধু যন্ত্রপাতি আর এয়ারকন্ডিশনড ওয়ার্ড নয়। মানবিক আচরণ, রোগীর নিরাপত্তা ও খরচের স্বচ্ছতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখন অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রোগীর অসহায় অবস্থাকে ব্যবসায়িক সুযোগে পরিণত করছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন আলোক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা বলেন, সব বিল কম্পিউটার-জেনারেটেড। মাঝে-মাঝে ত্রুটি হতে পারে। কেউ অভিযোগ করলে আমরা যাচাই করে সমাধান দিই। কিন্তু হাসপাতালের কাউন্টারে কথা বললে একাধিক কর্মী জানিয়েছেন, বিলিং সিস্টেম পুরোপুরি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। রোগী আপত্তি জানালে সাধারণত ছাড় দেওয়া হয় না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেসরকারি হাসপাতালের ওপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং জোরদার না হলে এ লুটপাট থামানো যাবে না। শুধু ‘অভিযোগ পেলেই অভিযান’ চালিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এখনই কিছু কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে রোগীদের আস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। অর্থনৈতিক শাস্তি ও লাইসেন্স বাতিলের বিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। না হলে সেবার নামে এ প্রতারণা আরো বাড়বে।
জানা গেছে, আলোক হাসপাতালের মালিক লোকমান হোসেন। তিনি সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লার কাছের লোক এবং জুলাই ছাত্রহত্যার আসামি। এখনো নেপথ্যে থেকে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তিনি অর্থায়ন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে বিভিন্ন পক্ষকে ম্যানেজ করে তিনি এখনো গ্রেফতার এড়িয়ে চলছেন।
লোকমানের সখ্য ছিল সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গেও। এখনো তার হাসপাতালে জাহিদ মালেকের ডান হাতখ্যাত একজন চাকরিরত আছেন। আওয়ামী লীগ আমলে লোকমান ব্যাপক প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালটি করেছেন। একটি হাসপাতালের অনুমোদন নিয়ে রাজধানীর মিরপুরে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তুলেছেন একাধিক শাখা। তার বিরুদ্ধে সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ারও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। নিজ এলাকা টাঙ্গাইলেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এসব নিয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকছে আমাদের অনুসন্ধানের পরের পর্বে।
কেকে/ এমএস