একটি জাতি গঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ নিয়ামক হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা সম্পর্কিত অপরিহার্য অনুষঙ্গগুলো হলো- শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাব্যবস্থাপনা। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এসব উপাদানের মধ্যে শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। কারণ শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। সমাজ বিনির্মাণে, সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে, সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে শিক্ষক নিজেকে বিলিয়ে দেন। তার হাত ধরেই সৃষ্টি হয়- এক একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, চৌকস রাজনীতিবিদ, দক্ষ অর্থনীতিবিদ, ত্যাগী চিকিৎসক, কৃতী প্রকৌশলী, বরেণ্য আইনজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
বর্তমানে যারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি, আইনের ধারক ও বাহক, অফিস আদালতের পরিচালক তারা একদিন কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীকে উন্নত চরিত্র গঠন, নৈতিক-মানবিক গুণাবলির বিকাশ এবং সমাজ বিবর্তনের অনুঘটক হয়ে সুশীল সমাজ তৈরিতে প্রতিশ্রুত। জাতিকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে তারা নিজেরা মোমের মতো নিঃশেষিত হন। আর তাই যথার্থই বলা হয়- শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা সভ্যতার অভিভাবক, সমাজ বিনির্মাণের প্রদায়ক।
যুগ পরম্পরায় নানান মানদণ্ডে যাচাই করে এই কথা বলার সময় এসেছে যে, শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং একটি মহান পেশা। পৃথিবীর বহু দেশে পেশা হিসেবে শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান আলাদা এবং তাদের আর্থিক সুবিধা সুউচ্চ মানের। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে শিক্ষকের জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল। সেসব দেশে সবচেয়ে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন। তারা শিক্ষকতাকে মহান পেশা ভেবেই সুশিক্ষিত জাতি গঠনের দায়িত্ব পালনে ব্রতী হন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এদেশে একজন শিক্ষকের জীবন চলার পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয় বরং তার ভবিষ্যৎ বিড়ম্বনাময়।
এখানে শিক্ষকের বেতন কম আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নগণ্য। আমাদের দেশে সামজিক মর্যাদা যেহেতু আর্থিক মানদণ্ডে নির্ধারিত হয়, সে কারণে শিক্ষকরা খুব বেশি সামাজিক মর্যাদা পান না। শুধু এ কারণেই মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। যারা আসেন তাদের কেউ কেউ নিতান্ত বাধ্য হয়েই আসেন। আর, যারা স্বপ্ন নিয়ে আসেন তারা হন আশাহত।
মনে রাখতে হবে- শিক্ষা ও শিক্ষকের মর্যাদা একে অপরের পরিপূরক। শিক্ষার উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষকের উন্নয়ন সর্বতোভাবে জড়িত। শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা ও জাতির আশা-আকাক্সক্ষার রূপায়ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ সম্পর্কযুক্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার অবনমনের প্রধান কারণ শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা। আর শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মোটের ওপর চার ধারায় বিভক্ত। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি বিদ্যালয়, বেসরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা এই ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। আবার একই কারণে শিক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারাও চার ধারায় বিভক্ত।
এর মধ্যে একটি অংশ সরকারি পূর্ণ সুবিধাপ্রাপ্ত, কেউ আংশিক সুবিধাপ্রাপ্ত কেউ আবার সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। ফলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করছে। এমন বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। একই সিলেবাস ও কারিকুলাম এবং নিয়মনীতি মেনে সমান দায়িত্ব পালন করার পরও একজন সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককের মধ্যে পাহাড় সমান বৈষম্য বিরাজমান।
দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়- সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া মূল বেতনের ৪৫ থেকে ৪০ শতাংশ কিন্তু এমপিওভুক্তদের মাত্র ১০০০ টাকা। চিকিৎসা ভাতা পান ১৫০০ টাকা, অন্যদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের উৎসব বোনাস মূল বেতনের ১০০ শতাংশ, অন্যদিকে এমপিওভুক্তদের মূল বেতনের ২৫ শতাংশ, যা সম্প্রতি ৫০ শতাংশে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। অবসরকালীন সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে মূল বেতনের ৯০ শতাংশ এর ৩০০ গুণ কিন্তু এমপিওভুক্তদের মূল বেতনের ৭৫ গুণ। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অবসরকালীন মাসিক ভাতা মূল বেতনের ৯০ শতাংশ ও চিকিৎসা ভাতা পান।
অন্যদিকে এমপিওভুক্তদের সেরকম কোনো সুবিধা নেই। অবসর সুবিধার জন্য সরকারিদের কোনো চাঁদা দিতে হয় না, এমপিওভুক্তদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সুবিধাজনক স্থানে বদলির সুযোগ পান কিন্তু এমপিওভুক্তদের বদলির কোনো ব্যবস্থা নেই। চাকরিতে যোগদান থেকে শুরু করে অবসরজীবন পর্যন্ত পদে পদে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক- কর্মচারীরা।
যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি কথাটিই অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, অমানবিক এবং বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে প্রধান অন্তরায়। সর্বোপরি বৈষম্যহীন ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের দেশের শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে অবনমিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো- পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সর্বনিন্মপর্যায়ে। কমনওয়েলথের সুপারিশ অনুযায়ী দেশের জাতীয় বাজেটের ২৫ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা থাকলেও এ যথাবৎ কালের কোনো সরকারই তা আমলে নেয়নি। প্রতি বাজেটেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের যেন বরাবরই দুরদৃষ্ট। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাদের বেতন-ভাতা বাড়ে না।
আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে সর্বজনীন, গণমুখী, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান মতে, রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবে। একই সঙ্গে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সে প্রয়োজন পূরণের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থাও করবে। এই অনুচ্ছেদের মর্মার্থ হলো- শিক্ষা মানুষের জন্মগত মৌলিক মানবিক অধিকার। আর এই অধিকার সবাই সমানভাবে প্রাপ্য হবেন। শিক্ষকদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদা সুরক্ষায় ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১৪৫টি সুপারিশ গৃহীত হয়।
এসব সুপারিশের মধ্যে শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, দায়িত্ব ও অধিকার, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম। প্রতিবছর নানা আয়োজনে সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের দেশেও বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় নানান সভা-সমাবেশ। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রকৃত মর্যাদা নিশ্চিতকরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখনো ন্যূনতম অধিকার আদায় করার দাবিতে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত রাস্তায় নামতে হয়। ন্যায্য দাবি চেয়ে পেতে হয় পুলিশের জলকামান আর লাঠিচার্জ। রক্তাক্ত হতে হয় জাতি গড়ার কারিগরদের।
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার সময় এসেছে। জাতিকে শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর দাঁড় করাতে হলে শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সরকারি, এমপিওভুক্ত, বেসরকারি বিভাজন নয় বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও আর্থিক সুবিধা প্রদানের বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার সার্বিক প্রসার এবং মানবিক গুণ বিকাশের গুরুদায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত। শিক্ষার উন্নয়ন ও দেশের অগ্রগতি একে-অপরের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিট।
বিষয়টিকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন সমাজ, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অগ্রগতিতে শিক্ষা এবং শিক্ষকের ভূমিকাই মুখ্য। তাই শিক্ষককে অবহেলিত রেখে দেশের কোনো অগ্রগতিই সম্ভব নয়। দেশ ও জাতি গঠনে যেহেতু শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। সেহেতু জাতির প্রয়োজনেই শিক্ষকের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা সমুন্নত রাখা জরুরি। অন্যথায় জাতির নিশ্চিত অগস্ত্য যাত্রা ঠেকানো সম্ভব হবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
কেক/ এমএস