সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, এবং নেপাল এই তিনটি দেশ, আলাদা ইতিহাস ও শাসন ব্যবস্থার হলেও সেখানে এমন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে যা শাসক শ্রেণীকে পদদলিত করে তাদের গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতা উন্মোচন করেছে। প্রতিটি ঘটনায় ভিন্নতা থাকলেও মিলের দিকগুলো চোখে পড়ার মতো। এই ঘটনাগুলো ভারতের জন্যও একটি আয়নার কাজ করতে পারে, যেখানে একই ধরনের রাজনৈতিক বিক্ষোভ রয়েছে, যদিও এখনো এগুলো খোলাখুলিভাবে বিদ্রোহের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তবে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে- পরবর্তী ক্ষেত্র কি ভারত? ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও উদ্বিগ্ন পর্যবেক্ষকরা এই প্রশ্নকে গুরুত্বসহকারে নিচ্ছেন। এর উত্তর খুঁজতে হলে এই আন্দোলনের সাধারণ বা অভিন্ন কারণগুলো বুঝা এবং সেগুলো ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বিদ্রোহের সাধারণ বিষয়সমূহ
১. বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য
এই তিনটি আন্দোলনই স্পষ্টভাবে বিপ্লবের চরিত্র বহন করেছিল। এগুলো ক্ষমতার মসৃণ হস্তান্তর ছিল না বা সাধারণভাবে আলোচনা করা সংস্কারও ছিল না; বরং এগুলো ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণ। অর্থনৈতিক ধস, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে সঞ্চিত বছরের পর বছরের হতাশা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়। যা শুরু হয়েছিল বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হিসেবে, তা বড় ধরনের জন-আন্দোলনে পরিণত হয়ে শাসক শ্রেণীকে ছুড়ে ফেলে শাসন ব্যবস্থার মূল কাঠামো পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়।
২. জেনারেশন জেডের উত্থান
এই আন্দোলনের একটি চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হলো তরুণ প্রজন্মের বিশেষ করে জেনারেশন জেডের প্রাধান্য। স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা এমনভাবে সংগঠিত হয় যা পুরোনো প্রজন্মের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শ্রীলঙ্কায় যুব নেতৃত্বাধীন “আরাগালায়া” আন্দোলন রাজাপাকসেদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন প্রতিবাদ দেশকে একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের দিকে নিয়ে আসে। নেপালে, হতাশ যুবকরা দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কাছে জবাবদিহিতা দাবি করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেনারেশন জেড অস্থির, রাজনৈতিকভাবে সচেতন, এবং ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা শাসকগোষ্ঠীর প্রতি কম সহনশীল। তারা অতীত সংগ্রামের স্মৃতির সঙ্গে আবদ্ধ নয়; বরং এমন একটি ভবিষ্যৎ দাবি করে যা তাদের জন্য কল্যাণ হবে।
৩. দুর্নীতি ও দুর্বল গণতন্ত্র
এই সংকটগুলোর মূল কেন্দ্রে রয়েছে এক পরিচিত গল্প : দুর্নীতি যা শাসনের ভিত্তি ক্ষয় করছে। শ্রীলঙ্কায় অর্বাচিনের মতো ঋণ গ্রহণ, অব্যবস্থাপনা ও ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করেছে এবং দেশকে অর্থনৈতিক ধসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার বিদেশে পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়কে বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়া এবং ভোট প্রক্রিয়ার অপব্যবহার ক্রমশ গণতান্ত্রিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করেছে। নেপালে, দলগত রাজনীতি ও গোপন সমঝোতা শাসন ব্যবস্থাকে ব্যক্তিগত লাভের খেলায় রূপান্তরিত করে যা নাগরিকদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি গভীর অবিশ্বাস তৈরি করে। যখন গণতন্ত্র দুর্বল হয় এবং দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ভোটের বাক্স আর পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে না। সেই সময় হতাশা রাস্তায় প্রকাশিত হয়।
৪. পরিবারের বা দলের মধ্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত
আরেকটি সাধারণ কারণ হলো- এক পরিবার বা দলের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতার প্রভাব। রাজাপাকসেরা শ্রীলঙ্কাকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছিল। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল, কঠোরভাবে ভিন্নমত দমন করছিল। যার ফলে শেখ পরিবার দেশের অখ্যাত শাসক হয়ে ওঠে। নেপালে, যদিও কোনো এক পরিবারের আধিপত্য ছিল না তথাপি একটি ছোট অভিজাত মহলের মধ্যেই ক্রমাগত ক্ষমতার হাত বদল হচ্ছিল। ফলাফল একই : সাধারণ নাগরিকরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে পড়ে থাকার অনুভূতি পাচ্ছিল।
বাহিরের প্রভাব
এই সংকটগুলোয় বাহিরের শক্তির কিছু ভূমিকা ছিল। যদিও এই ভূমিকা এবং প্রকৃতির মধ্যে ভিন্নতা ছিল। শ্রীলঙ্কায় চীনের ঋণ দেশকে অসহনীয় দেউলিয়াপনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, আর পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে বয়ান দিয়ে গেছে। নেপাল আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশে বহিরাগত প্রভাব বিশেষভাবে দৃশ্যমান ছিল। ভারতের আওয়ামী লীগের প্রতি স্পষ্ট সমর্থন, বিশেষ করে পর পর কয়েকটি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এর প্রকাশ্য প্রভাব এবং হস্তক্ষেপ কূটনীতির শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল। যা শুরু হয়েছিল ছাত্র-নেতৃত্বাধীন চাকরিতে বৈষম্যহীন আন্দোলন হিসেবে, তা দ্রুত সর্ব স্তরের জনগণকে রাস্তায় নিয়ে আসে। এখোনে মূল উদ্দীপক ছিল ভারতবিরোধী অনুভূতি, যা জনগণের হতাশার প্রতি ভারতের এবং আওয়ামী লীগের উদাসীনতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই ক্রোধই আন্দোলনের শক্তি ও জনপ্রিয় ন্যায্যতা জুগিয়েছিল।
ভারতের জন্য সংকেত
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং নেপালের অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য একটি জরুরি প্রশ্ন উত্থাপন করে : দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভেতরে কি একই ধরনের অস্থিরতার ঝড় আসতে পারে? কয়েকটি সতর্ক সংকেত এই দেশও অরক্ষিত নয় বলে ইঙ্গিত দেয়। দুর্নীতি ব্যাপক ও দৃশ্যমান, যেমন আদানি গ্রুপ সম্পর্কিত বড় কর্পোরেট কেলেঙ্কারি। বিরোধী দলগুলো সরকারকে জবাবদিহি করতে এবং প্রমাণসহ অভিযোগ প্রকাশ করতে ক্রমশ সক্রিয় হচ্ছে। গণতান্ত্রিক অবক্ষয় একটি উদ্বেগের বিষয়, যেমন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ নিয়ে চলমান বিতর্ক। ক্ষমতার কুক্ষিগত করার প্রবণতা বেড়েছে, একক দল ও এক নেতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। বিরোধী দল, বিশেষ করে কংগ্রেস, শাসক দলকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি বা অব্যাবস্থার প্রমাণ দেখিয়ে নির্বাচনের অপকৌশল প্রয়োগের অভিযোগ করছে। তরুণদের হতাশা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে। প্রতি বছর লাখ লাখ যুবক কর্মবাজারে প্রবেশ করছে এবং বেকারত্ব স্থির উচ্চ মাত্রায় রয়েছে। হতাশা প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, যা তরুণদের পরিবর্তন ও প্রতিবাদ আহ্বানে বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে। অভ্যন্তরীণ এ চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি, আরো কিছু উদীয়মান উদ্দীপক যুব প্রজন্মের মধ্যে অস্থিরতাকে বাড়াতে পারে। কাশ্মীরের জটিল সমস্যা, চলমান ‘লাদাখ’ এর রাজ্যের মর্যাদার আন্দোলন, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রবণতার উত্থান এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান উত্তেজিত সম্পর্ক সংকটের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। এই প্রভাবগুলো যুবকদের মধ্যে সম্পর্কহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে, যা তাদের পরিবর্তনের আহ্বানের প্রতি আরো সংবেদনশীল করে তোলে।
ভারত কেন আলাদা?
কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে ভারতের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর ফেডারেল কাঠামো, যেখানে রাজ্য সরকারগুলোর হাতে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা রয়েছে, স্থানীয় শাসন ও নীতি প্রয়োগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ দেয়, যা সমগ্র দেশে সংকটকে একইভাবে প্রভাবিত হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের বিশাল মাত্রা-রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের একাধিক কেন্দ্রের জন্ম দেয়, যার ফলে হতাশা একক জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেওয়া কঠিন। পাশাপাশি, ভারতের সক্রিয় নাগরিক সমাজ-এনজিও, পেশাজীবী সংস্থা, কর্মী গোষ্ঠী এবং স্বাধীন মিডিয়া-প্রতিবাদী ও পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে, যাতে ক্ষোভের উদয় আগে থেকে দেখা যায় এবং কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায়। এই সকল উপাদান একসঙ্গে স্বাভাবিক ঝাঁকুনি নিরোধক হিসেবে কাজ করে, যা উত্তেজনা ও অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করে এবং বড় ধরনের আন্দোলনের সূচনাকে বিলম্বিত করে।
উপসংহার
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, এবং নেপাল এই তিন দেশের সাম্প্রতিক বিপ্লব একটি সাধারণ দক্ষিণ এশিয়ার গল্প : যখন সরকার অতিরিক্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে, যখন দুর্নীতি শাসনের ভিত্তি ক্ষয় করে এবং যখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়, তখন নাগরিকরা- বিশেষ করে যুবকরা তাদের ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধার করতে রাস্তায় নেমে আসে। এগুলো বিচ্ছিন্ন জাতীয় ঘটনা নয়; এগুলো আঞ্চলিক সংকেত। ভারতের জন্য সংকেত স্পষ্ট : স্থিতিশীলতা কখনোই নিশ্চিত নয়। প্রতিবেশীদের ওপর যে শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলো ভারতের ভেতরও রয়েছে, শুধুমাত্র একটি স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষা। ভারত ফেডারেলিজম, বৈচিত্র্য, এবং শক্তিশালী নাগরিক সমাজ থেকে উপকৃত হলেও, আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং আদর্শিক মেরুকরণ থেকে শুরু করে বিদেশি প্রভাব পর্যন্ত অতিরিক্ত অনুঘটকগুলি কাঠামোগত দুর্বলতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে একটি বিস্ফোরক অবস্থা তৈরি করতে পারে। ভারতের জন্য পছন্দ স্পষ্ট : ইতিহাস থেকে শিক্ষা, অথবা বিস্ফোরণের ঝুঁকি।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
কেকে/এজে