দেশের প্রধান শহরগুলোতে আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ইস্যুতে বেড়েই চলেছে প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড। রোববার (৩০ নভেম্বর) খুলনা আদালতে হাজিরা দিতে আসা দুই আসামিকে আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা একটি মামলার আসামি হিসেবে হাজিরা দিয়ে আদালত থেকে বাইরে বের হওয়ার পরই একাধিক গুলির পর কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা। আদালতের মতো একটি নিরাপদ যায়গায়ও যখন প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে তখন প্রশ্ন জাগে, সাধারণ মানুষ আসলে কোথায় নিরাপদ?
দেশের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি এতই নাজুক যে, গত ১০ মাসে খোদ রাজধানীতেই ১৯৮টির বেশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রকাশ্যে গুলি করে বা কুপিয়ে। গত মাসের ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর পল্লবীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে। এর আগে ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকায় ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে মামুন নামের একজনকে ফিল্মি স্ট্যাইলে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
গত ১১ নভেম্বর মোহাম্মদপুরে পাওয়া যায় এক ছাত্রদল কর্মীর লাশ। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গভীর সংকটকে স্পষ্ট করেছে। এভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা শুধু ব্যক্তিগত টার্গেট নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড টার্গেট কিলিং কিনা প্রশ্ন রয়ে যায়। দেশে এ মুহূর্তে সবথেকে উদ্বেগের বিষয় হলো ‘টার্গেট কিলিং’।
চট্টগ্রাম পুলিশের দেওয়া তথ্যানুয়ায়ী, খোদ চট্টগ্রামের রাউজানেই ৬টি টার্গেট কিলিং গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। যেখানে ৭ অক্টোবর হাটহাজারীর মদুনাঘাট ব্রিজের কাছে একদল লোক প্রাইভেট কার আটকে রাউজানের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে গুলি করে হত্যা করে। চালিতাতলীতে আসন্ন নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। ওই হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। বিগত কয়েক মাসের পরিসংখ্যান আমাদের এ চিত্রই দেখায়।
গত ১৪ মাসে ৪০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে রাউজান উপজেলাতেই ১৭টি। যার মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। এ সংকটের ভেতর যে প্রশ্নটি জনমনে উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে সেটি হলো এসব হত্যাকাণ্ড কি টার্গেট কিলিং নাকি স্রেফ সাধারণ মামুলি খুন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মধ্যেও বাড়ছে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের ৮০ ও ৯০ দশকের মহল্লাভিত্তিক গ্যাং কালচারের কথা মনে করিয়ে দেয়। দেশের মেগা সিটিগুলো মহল্লাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের সেই পুরোনো খেলায় ফিরে গেলে তার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
চট্টগ্রাম ও ঢাকার পর এবার খুলনাতেও সেই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ১৪ মাসে খুলনা সিটিতে কমপক্ষে ৪৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়েই বেশি। পুলিশের ধারণা, আদালত প্রাঙ্গণের এ হত্যাকাণ্ড পলাশ গ্রুপের সঙ্গে গ্রেনেড বাবু গ্রুপের বিরোধিতা থেকে ঘটেছে। নিহতরা পলাশ গ্রুপের সদস্য বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
দেশের এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তৎপরতা জরুরি। জননিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস নয়। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সন্ত্রাস দমনে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নয়তো মহল্লাভিত্তিক এ গ্যাং সংস্কৃতি দেশ ও দেশের মানুষকে গভীর নিরাপত্তা সংকটে ফেলবে।
কেকে/এমএ