বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫,
২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: আন্দোলনরত শিক্ষকরা কাজে না ফিরলে আইনি ব্যবস্থা      রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসিকে তফসিল দেওয়ার আহ্বান নাহিদের      খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে প্রধান উপদেষ্টা      অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করতে হবে : উপদেষ্টা ফরিদা      প্রবাসীরা ৬০ দিনের বেশি দেশে থাকলে ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে      এভারকেয়ারের পাশে সেনা-বিমান বাহিনীর মহড়ায় বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ      শীত নিয়ে দুঃসংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
আজও হয়নি পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন
রেজাউল করিম খোকন
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৯:৫৩ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ওঠে। এই দাবিতে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ১৯৭৩ সালে সংগঠনটির সশস্ত্র শাখা কথিত শান্তিবাহিনী গঠন হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তি চুক্তি)। এটি পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। 

চুক্তির আওতায় গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ১টি শক্তিশালী (ভারতের অঙ্গরাজ্যের আদলে) আঞ্চলিক পরিষদ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুবিষয়ক টাস্কফোর্স  এবং ৩ জেলায় ৩টি স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য জেলা পরিষদ। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) মোট জনসংখ্যা ছিল ১৮,৪২,৮১৫ জন। তবে ধারণা করা হচ্ছে এ জনসংখ্যা এখন ২০ লাখের মতো। যা দেশের ১১.১৯ শতাংশ আয়তনের মধ্যে ১.১৬ শতাংশ মানুষের বসবাস। জনশুমারির হিসাব মতে এর মধ্যে: উপজাতি মোট: ৯,২০,২১৭ জন (৪৯.৯৪%) এবং বাঙালি ৫০.০৬ শতাংশ তথা ৯,২২,৫৯৮ জন। 

শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে। এর মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সেজন্য বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ এই পরিষদের অধীনে থাকবে; পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া; পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা ইত্যাদি। শান্তি চুক্তির ধারাবাহিকতায় বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সে অঞ্চলে গঠন করা হয়েছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নয়। এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অনীহার সমন্বিত ফল। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সত্ত্বেও পাহাড়ে যে সহিংসতা, ভূমি দখলের সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে, তা এ বিচারহীনতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে পাকিস্তান আমলে। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে স্বাধীনতার পরও। এ বিচারহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দূর করতে  পার্বত্য চুক্তির ধারাগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভূমি কমিশনের পুনঃসক্রিয়করণ ও একটি স্বাধীন মানবাধিকার তদন্ত কমিশন গঠন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা বরাবরই রাজনৈতিক নেতাদের অনাগ্রহ দেখেছি। আসলে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। তাহলেও কিছুটা শান্তি সেখানে মিলতে পারে। শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত ২৬ বছরে ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ে। এসব দল নিজেরাও অভ্যন্তরীণ বিরোধেও জড়াচ্ছে।  

পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। এ পর্যন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানে কোনো সফলতা আসেনি। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নয়, এখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের  বিষয়টির সমন্বয় করে থাকে। ফলে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা বলা মুশকিল। 

সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি। বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন, এ সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৮৯৯ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন, চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন। কিন্তু কোনো ঘটনারই দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি। সংঘাত এড়াতে পার্বত্য জেলাগুলোর পাড়া-মহল্লায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিয়ে বৈঠক করছে জেলা প্রশাসন। গঠন করা হয়েছে একাধিক সম্প্রীতি কমিটিও।

পাহাড়ে যেটা হচ্ছে, সেটা শোভন নয়। আমরা সেখানে আর কোনো রক্তপাত দেখতে চাই না। আমরা এটাও চাই না যে, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কেউ মৃত্যুবরণ করুক। অন্তর্বর্তী এই সরকারে পাহাড়ের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা আশা করি, এখন যিনি সরকারপ্রধান তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। ফলে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন, তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। প্রশাসনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্যান্য  নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের হাতেই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। অন্যদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে দুর্বল, বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিষদগুলোতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর। যথা- এক. প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বা বিনা নির্বাচনে পরিচালিত পরিষদগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। দুই. নিরাপত্তার ভারসাম্য বা সেনা উপস্থিতি যেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, শাসন নয়। তিন. সামাজিক সংহতি বা পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ও অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

বিশেষ অঞ্চল হিসেবে নিরাপত্তার বাস্তবতায়, সেনাবাহিনী দৃশ্যমান হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত আইন ও কাঠামো অনুযায়ী, পাহাড়ি নেতৃত্বই এখানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আরও সহজভাবে বললে- পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন করছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকজন। তবে সংখ্যায় অর্ধেক জনসংখ্যা হলেও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে, বাঙালিরা প্রান্তিক। এই বাস্তবতা থেকেই উঠে আসে দ্বন্দ্ব, অভিযোগ, এবং ‘সেনা শাসন বনাম পাহাড়ি আধিপত্য’ বিতর্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে গণতন্ত্র, সংলাপ ও সমতার ভিত্তিতে একটি নতুন কাঠামো নির্মাণের ওপর। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক: খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা তারই অংশ। 

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তখন স্থানীয় পাহাড়ি রাজা ও সম্প্রদায়কে আঞ্চলিক শাসনের অধিকার দেওয়া হয়। জমির মালিকানা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মূলত উপজাতীয় সমাজের হাতে রাখা হয়। ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসন মজবুত ছিল। ব্রিটিশ শাসন শেষে পাকিস্তান আমলেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক অবহেলা, বৈষম্য ও শোষণ চলতে থাকে; সেই সময় কেন্দ্রীয় শাসন স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। 

এর ফলে জমি দখল, প্রশাসনিক নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে সামাজিক অস্থিরতার ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে; কখনো তারা নিজস্ব জাতিগত স্বার্থ রক্ষা করতে, আবার কখনো বাইরের রাজনৈতিক প্রভাবে হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকেই ভারতে ও মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়। এই বাস্তুচ্যুতি পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের বীজ বোনা হয়। স্বাধীনতার পরেও পরিস্থিতি পালটায়নি। 

স্বাধীনতার পর প্রথম আওয়ামী সরকারের অধীনে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে স্থানীয় সশস্ত্রবিরোধী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হয় এবং বসতি সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় কিছু নিরীহ বাঙালি পরিবারও লক্ষ্যবস্তু হয়। তখনকার রাজনৈতিক সমর্থক ও একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিতেন এবং অনেক ঘটনাই স্থানীয় প্রশাসন ও মিডিয়ায় বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হতো; এতে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন, জমির অধিকার ও সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিতের দাবি তুলে ধরলেও সংঘাত থামেনি। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ও পরবর্তী সামরিক শাসনের সময় পাহাড়ে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেনা অভিযান এবং স্থানীয় একশ্রেণির নেতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে বহু বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরবর্তী কয়েক দশকেও শান্তি অর্জিত হয়নি। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোতে শান্তিবাহিনী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ সেনা ও ৩০ হাজার বাঙালি নিহত হয়। শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত ও সম্পদ ধ্বংসের শিকার হয় এবং নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সংঘাত কমার বদলে নতুন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। 
ঘটনাবলির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবে স্থায়ী সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রশাসনিক বিভাজন, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সম্পদ লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডকে থামাতে পারেনি এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

চুক্তির প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে-কিছু বিশ্লেষক এটাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। চুক্তির পর অনেক জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে; চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক দখলদারির ঘটনা নিত্যসংবাদে পরিণত হয়। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে বাস্তব উন্নয়ন কাজেও বাধা এসেছে। যদিও সরকারি নীতিতে প্রায়ই ‘পাহাড়িদের উন্নয়ন’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বরং স্থানীয় বাঙালিদের দুরবস্থার বিষয়টি নানাবিধ কারণে উপেক্ষিত থেকে যায়। এখানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আরও দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। বলা হয়, চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলকভাবে উন্নত এবং চাকমা নারীদের মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য; অন্যদিকে কয়েকটি এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত হার কমে গেছে। এ ছাড়া কিছু পাহাড়ি এলাকায় জমি লিজ দেওয়া ও পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যা রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকারের দিক থেকে বিতর্কিত। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা ও মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী সূত্রবিহীনভাবে ছড়ানো ঝুটো অভিযোগ, সীমান্তের বাইরের প্রশিক্ষণ ও সাহায্য ইত্যাদি প্রতিহত করতে হবে। তবে পুরোটাই কেবল শক্তি প্রদর্শন করে সমাধান না করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রমাণভিত্তিক তদন্ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ঐক্য রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও প্রয়োজন। একই সঙ্গে সামরিক ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি, যাতে নিরাপত্তা বজায় রেখে জনসাধারণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা যায়। বর্তমানে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা কমাতে সেনা ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট বৃদ্ধির প্রস্তাব উঠেছে; বিশেষত কিছু সম্ভাব্য সুপারিশে খাগড়াছড়িতে ক্যাম্পসংখ্যা ২৫০-এ উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পরে সেনাক্যাম্প কমানো হয়। যদিও কিছু মানুষ মনে করেন সেনা উপস্থিতি বাড়লেই নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে, তবে অন্যরা আশঙ্কা করেন এতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই সেনাক্যাম্প এবং সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্থানীয় মতামত, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও মানবাধিকার বিবেচনা করে আসন্ন নীতি গ্রহণ করা উচিত।

পার্বত্য শান্তি নামক দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী কালো চুক্তি বাতিল করা অথবা পার্বত্য সমস্যার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে চুক্তি বা নীতি-নবায়ন করা, যেখানে প্রয়োজন হলে ১৯৯৭ সালের চুক্তির  দুর্বলতা শনাক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক, বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায্য কাঠামোর আওতায় নতুন সমঝোতা গঠন করা হবে। জনগণের আস্থাভিত্তিক নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে শক্ত মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু সেই শক্তি প্রয়োগ মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; এখানে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি-সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার সমান। যে কোনো বিভাজনমূলক শব্দ বা ধারণা জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি; তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে মিলেই কাজ করতে হবে, যাতে পাহাড়ে নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও উন্নয়ন একসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে যে, সীমান্তের উভয় পাশে সংঘর্ষ-প্রবণতা ও স্বাধীনতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রয়েছে। তাই সীমান্ত তত্ত্বাবধান আরো জোরদার, গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার উৎস নির্ণয় ও সমাধান করা দরকার। 

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনকে দেশের সবার অধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। আদিবাসীরাও এ দেশের মূলধারার মানুষ। তারাও এ দেশের নাগরিক। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে হলে সেনাবাহিনীর সদিচ্ছা জরুরি বলে মনে করি। এই দেশে কোনো সরকারের কোনো এখতিয়ার ছিল না আদিবাসী অধিকার রক্ষা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি শান্তি ফেরাতে পারে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে কেন তারা সে উদাহরণ তৈরি করতে পারবে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একমাত্র শক্তি, তাদের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি সম্ভব। 

১৯৯৭ সালে চুক্তির পর আমরা  ভেবেছিলাম একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। চুক্তির কোন অংশ কখন বাস্তবায়ন করা হবে এ রকম সময় নির্ধারণ করা ছিল না। রাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যে জীবনধারা, তাদের যে মানবাধিকার, ভূমি অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, নাগরিক অধিকারকে আমরা স্বীকার করতে চাই না। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তির খোঁজে প্রায় ২৭ বছর আগে শান্তি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু শান্তি ফেরেনি, এখনো পড়ছে লাশ, ঝরছে রক্ত। শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারই পারে পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  পার্বত্য শান্তি চুক্তি   বাস্তবায়ন  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হামজা-শমিতদের ম্যাচ থেকে ৪ কোটির বেশি আয় বাফুফের
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে যোগ দিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩
দশমিনায় মৎস্য মেরিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

সর্বাধিক পঠিত

বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে প্রার্থনা সভা
সাভারে টিভি সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরসি'র আত্মপ্রকাশ
ফটিকছড়িতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
বিএনপি নেতার পুকুরে বিষপ্রয়োগ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close