উচ্চ সুদহার ও কম ঋণপ্রবাহ- এই দুই মিলেই একটি অর্থনীতিতে সবচেয়ে বিপজ্জনক অচলাবস্থা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, নীতিসংক্রান্ত সুদহার বাড়ার ফলে ঋণের খরচ বেড়েছে এবং একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণও ঐতিহাসিকভাবে কমে গেছে। ফলে ব্যবসা, উৎপাদন ও বিনিয়োগ- সব ক্ষেত্রেই স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রবণতা চলতে থাকলে একটি দেশের শিল্প খাত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়।
সম্প্রতি সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ-জিইডি একনেকের সামনে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ, যা আগের মাসের ৬.৩৫ শতাংশ থেকে আরও কম। গত চার বছরে এটি সর্বনিম্ন স্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ২০২৫ অর্থবছরের ৭.২ শতাংশের অনেক নিচে। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এই নিম্নমুখী প্রবাহের অর্থ দাঁড়ায়, বিনিয়োগ কার্যত ‘ডেড জোনে’। দেশের ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের ফাঁদও এখন একটি ‘স্ট্রাকচারাল ব্যারিয়ার’। ২০২৫ সালের সর্বশেষ ছয় মাসের তথ্য দেখায়, বিদেশি ব্যাংকগুলোর স্প্রেড সবচেয়ে বেশি, আগস্টে যা দাঁড়ায় ৯.২২%, সেপ্টেম্বরেও ছিল ৮.৯৮%। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর স্প্রেডও এপ্রিলের ৫.৯৫% থেকে সেপ্টেম্বরে ৫.৭৪% নামলেও উচ্চই রয়ে গেছে।
এ ধরনের উচ্চ স্প্রেডের পেছনে রয়েছে অব্যবস্থাপিত খেলাপি ঋণ (এনপিএল), পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারের অতিরিক্ত ঘনত্ব, যেখানে কার্যকর প্রতিযোগিতার ঘাটতি থাকায় সুদের হার কমার পরিবেশ তৈরি হয় না। ফলে উচ্চ সুদের প্রথম অভিঘাত পড়ে বিনিয়োগের ওপর। ঋণ ব্যয়বহুল হওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প শুরু করতে বা সম্প্রসারণ করতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠেন। বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এসএমই সহজ শর্তের ঋণ না পাওয়ায় উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ বা এনপিএল বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকি গ্রহণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ঋণ পাওয়ার যোগ্য গ্রাহকরাও কাক্সিক্ষত সহায়তা পান না। এই অবস্থাকে অর্থনীতিবিদরা ‘ক্রেডিট ক্রাঞ্চ’ অর্থাৎ ঋণ সংকট- হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
ঋণ সংকট আরও গভীর হয় যখন মুদ্রানীতি কঠোর থাকে। সুদহার বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি কমানো গেলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক চাপ পড়ে। এর ফলে শিল্পোৎপাদন কমে, আমদানি-নির্ভর খাতগুলো সংকুচিত হয় এবং ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুর্বল হতে থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়া একটি ‘বিষাক্ত চক্র’- উচ্চ সুদ → কম ঋণপ্রবাহ → কম বিনিয়োগ → মন্থর প্রবৃদ্ধি তৈরি করে, যা থেকে বের হওয়া কঠিন।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিক নীতি প্রয়োগ করলে এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। প্রথমত, নীতিসংক্রান্ত সুদহার দ্রুত নয়, বরং তথ্য-নির্ভর ধীর গতিতে কমাতে হবে, যাতে বাজারে আস্থার সংকট না তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দ্রুত শনাক্ত ও পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে ব্যাংকগুলো আবার ঋণ দিতে সক্ষম হয়। তৃতীয়ত, এসএমই, কৃষি ও উৎপাদনমুখী খাতে লক্ষ্যভিত্তিক সাশ্রয়ী ঋণ সরবরাহ জরুরি- কারণ এই সেক্টরগুলোই কর্মসংস্থান ধরে রাখে। সঙ্গে নীতির স্বচ্ছতা ও সরকার-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট যোগাযোগ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। সব মিলিয়ে, উচ্চ সুদহার এবং কম ঋণপ্রবাহ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অর্থনীতি স্থবিরতা, বেকারত্ব ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়। বিপরীতে, সুসংগঠিত মুদ্রানীতি, শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং লক্ষ্যভিত্তিক ঋণসুবিধা অর্থনীতিকে আবার গতিশীল করে তুলতে পারে।
কেকে/এআর