অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, যখন কোনো পণ্যের উৎপাদন বা সরবরাহ বাড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার দাম কমে আসার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের চালের বাজার যেন সেই চিরাচরিত সূত্রকে বরাবরই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে। প্রতিবছরই, বিশেষ করে আমন ও বোরো মৌসুমে, যখন ধানের বাম্পার ফলন হয় এবং তখনো চালের দাম কেবল স্থির থাকে না, বরং অনেক সময় উল্টো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। এটি শুধু অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় নয়, এটি দেশের কোটি কোটি সাধারণ ভোক্তা, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য এক চরম ভোগান্তির কারণ।
প্রশ্ন হলো, বাম্পার ফলন এবং সরকারের গুদামে রেকর্ড পরিমাণ মজুত থাকা সত্তে¡ও চালের দামে এই অস্বাভাবিক অস্থিরতা ও ক্রমাগত বৃদ্ধি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খলের গভীরে লুকিয়ে থাকা ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’-এর কারসাজির বিষয়টি সামনে চলে আসে।
সাধারণত, আমন ধান কাটার মৌসুম শুরু হলে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ বাড়ে, যা দাম কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোর চিত্র ভিন্ন। কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েও ধানের ন্যায্য দাম পান না, আবার অন্যদিকে ভোক্তাদেরও কিনতে হয় বেশি দামে। এই দুই মেরুর বিপরীতমুখী অবস্থানের মূল কারণটি হচ্ছে মিল মালিক, মজুতদার এবং বর্তমানে চাল ব্যবসায় করপোরেট গ্রুপগুলোর এক শক্তিশালী জোট। এদের হাতেই বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
কৃষকরা যখন উৎপাদিত ধান সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে আসেন, তখন নানা অজুহাতে তাদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে ধান কেনা হয়। অনেক সময় উৎপাদন খরচ বাড়লেও ধানের দাম সেই অনুপাতে বাড়ে না। ফলে কৃষকরা ফসলের লাভজনক দাম থেকে বঞ্চিত হন। এরপর সেই ধান চলে যায় বড় বড় মিল মালিক ও মজুতদারদের হাতে। তারা ধাপে ধাপে বাজারে চাল সরবরাহ করে এক কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। বাজারে চালের ঘাটতি নেই, সরকারের মজুতও বেশ ভালো, এমনকি কোনো কোনো বছরে বিশ্ববাজারে চালের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকলেও দেশে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। এ অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল কলকাঠি নাড়ছে এক শক্তিশালী চক্র, যাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ধান মজুত করার সক্ষমতা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চাল ব্যবসায় করপোরেট কোম্পানিগুলোর প্রবেশ এই সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করেছে। তারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে বা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ধান কিনে মজুত করে। এরপর সেই চাল প্যাকেজিং করে ‘ভিআইপি চাল’ বা ব্র্যান্ডেড চাল হিসেবে চড়া দামে বাজারে ছাড়ে। এই প্রক্রিয়ায় একদিকে যেমন খোলা বাজারের চালের সরবরাহ কমে যায়, তেমনি প্যাকেজিং করা চালের উচ্চমূল্য সাধারণ চালের দামকেও প্রভাবিত করে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, যে মিনিকেট চাল খোলা বাজারে একটি দামে বিক্রি হয়, একই মানের ভিআইপি চাল তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই দামের পার্থক্য পুরো চালের বাজারকে অস্থির করে তোলে। এখন করপোরেট গ্রুপগুলো চালের বাজারের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করায়, তাদের সংঘবদ্ধ কৌশল বাজারের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংকটের মূলে রয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা। প্রথমত, কৃষি উৎপাদিত ফসলের সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যে অনেক সময় গরমিল দেখা যায়, যার ফলে বাজার সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। মজুতদাররা এই অনির্ভরযোগ্য তথ্যের সুযোগ নিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় কারসাজি করে। দ্বিতীয়ত, সরকারের মনিটরিং ও বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। চালের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় শুল্ক প্রত্যাহার বা আমদানি শুরুর মতো পদক্ষেপ নিলেও মজুতদারদের লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ দেখা যায় না। বাজারে কে কতটুকু ধান বা চাল মজুত করতে পারবে, সে বিষয়ে আইনি কাঠামো থাকলেও তার বাস্তবায়ন অনেকটাই শিথিল। মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলা হলেও, বাজারে তার স্থায়ী প্রভাব খুব কমই দেখা যায়।
চাল মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য এবং মূল্যস্ফীতির ঝুড়িতে এর অংশ প্রায় এক-দশমাংশ। ফলে চালের দাম বাড়লে তা সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয় এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষেরা। চালের দাম বাড়ার কারণে নিম্নবিত্তের মানুষেরা মাছ, মাংস, ডাল বা সবজির মতো পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান বাদ দিয়ে কেবল ভাতনির্ভর খাদ্যে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এ কারণে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং প্রতি ১০ জনে ৩ জন প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছেন পারছেন না।
চাল উৎপাদনের বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বে ও যদি ভরা মৌসুমেও দামের এই লাগামহীন বৃদ্ধি চলতে থাকে, তবে তা সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর পদক্ষেপ অপরিহার্য। কেবল ফলন বাড়লেই হবে না, সেই ফলনের সুফল যেন মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে না গিয়ে সরাসরি ভোক্তা ও কৃষকের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরবরাহ শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা করা। ধানের উৎপাদন থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন এবং খুচরা বাজারে বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তথ্য যাচাই-বাছাই ও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। চালের বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে এবং যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনভোগান্তি বাড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান বা চাল কেনার সরকারি প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করতে হবে।
পাশাপাশি, দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য ওএমএস এবং রেশনিং ব্যবস্থার আওতা বাড়িয়ে তাদেরকে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। আমন ধানের বাম্পার ফলন সত্ত্বেও চালের দামে লাগাম টানতে না পারাটা স্পষ্টত দেশের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ও বাজার ব্যবস্থাপনার গভীর দুর্বলতাকেই নির্দেশ করে। এটি কেবল অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় নয়, বরং দেশের কোটি কোটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর নেমে আসা এক অসহনীয় দুর্ভোগ। একদিকে কৃষকরা পাচ্ছেন না তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য, অন্যদিকে ভোক্তারা সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চড়া দামে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। মিলার, মজুতদার এবং করপোরেট কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে গঠিত এই ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’ বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।
এই চক্র ভাঙতে হলে সরকারকে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, মজুতদারি নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং নিয়মিত বাজার তদারকি অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, কৃষি উৎপাদন ও মজুত সংক্রান্ত তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কারসাজির সুযোগ কমে আসে এবং তৃতীয়ত, সরকারের খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে কৃষকের ন্যায্য দাম এবং দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। বাম্পার ফলনের সুফল জনগণের ঘরে পৌঁছে দিতে না পারলে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কেকে/এমএ