সিসার বিষাক্ত উপাদান ক্রমেই আমাদের শিশুদের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা এখন বড় হচ্ছে তারা নানামুখী দূষণের শিকার। তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। বছরের পর বছর এসব দূষণ আমাদের মানব শরীরে প্রভাব বিস্তার করছে এবং নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করছে। ফলে একটি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো সিসা দূষণ। যদিও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ দূষণ নিয়ে তেমন কোনো সচেতনতা নেই। কাজের স্থানে সিসার সংস্পর্শে আসছে তারা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সিসার দূষণে ধুঁকছে সারা বিশ্বের মানুষ। তবে বাংলাদেশের অবস্থান এ দূষণের তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে যা উদ্বেগজনক। সম্প্রতি এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে শিশুদের খেলনায় সিসা, পারদ ও ক্যাডমিয়ামসহ বিষাক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে লেড-৬৫ দশমিক ৮৫ পিপিএম, যা নির্ধারিত সীমার প্রায় ৫ গুণেরও বেশি। আমাদের শিশুরা ছোটোবেলা থেকেই এসব খেলনা নিয়ে বড় হচ্ছে।
২০২০ সালে ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে সিসার বিষক্রিয়া নিয়ে ভয়ংকর তথ্য উঠে আসে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন শিশুর একজন বা প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি। অর্থাৎ এ শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ শিশুদের প্রায় অর্ধেকের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়।
বাংলাদেশের শিশু ও নারীদের ওপর পরিচালিত সবচেয়ে বিশদ জরিপ ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০২৫ বলছে, ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সি ৩৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার পরিমাণ নিরাপদ সীমার ওপরে। আর অন্তসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশ একই ঝুঁকিতে রয়েছেন। সিসা দূষণের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সিসামিশ্রিত খেলনা, দূষিত মসলা, রং, পুরোনো ব্যাটারি ও শিল্পদূষণ। রাজধানীর ২ থেকে ৪ বছর বয়সি শিশুদের রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
যা তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও শারীরিক সুস্থতায় মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণা ফলাফলে ৫০০ শিশুর নমুনার ৯৮ শতাংশতে সিসা পাওয়া গেছে, যার মধ্যম মাত্রা ৬৭ মাইক্রোগ্রাম/লিটার। অথচ সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মানদণ্ড অনুসারে উদ্বেগজনক মাত্রাই ৩৫ মাইক্রোগ্রাম/লিটার। আর ঢাকার আশপাশে সিসানির্ভর কারখানার এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা অন্যদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পরিচালিত গবেষণায় ২ থেকে ৪ বছর বয়সি ৫০০ শিশুর রক্ত পরীক্ষা করে প্রতিটি শিশুর রক্তেই রয়েছে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ঢাকার বস্তি এলাকায় ২ বছরের কম বয়সি ৮৭ শতাংশ শিশুর রক্তে প্রতি লিটারে সিসার মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি ছিল, যা তাদের শারীরিক বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতার একটি প্রধান কারণ।
সিসাদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। বর্তমানে দেশে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সবার জন্য একটি সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সিসাদূষণ রোধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ক্ষতি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। দুর্ভাগ্যবশত শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশের সময়সীমা কমে যায় এবং প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ দেখা দেয়, আর গর্ভবতী নারীদের অনাগত শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্মশালায় জানানো হয়, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ খুলনা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী ও সিলেট জেলায় ৯৮০ জন এবং ঢাকায় ৫০০ শিশুকে পরীক্ষা করে সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি পেয়েছে। এসব নমুনার মধ্যে চার জেলায় ৪০ শতাংশ এবং ঢাকায় ৮০ শতাংশ নমুনায় প্রতি ডেসিলিটার রক্তে পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসা পাওয়া যায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ন্যূনতম মাত্রার চেয়ে বেশি।
অবশ্য শিশুদের রক্তে কোনো মাত্রার সিসার উপস্থিতিই নিরাপদ নয়। পরিসংখ্যান বলছে, এর কারণে বাংলাদেশ আনুমানিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে যা কি না ২০১৯ সালের দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৩.৫% এর সমান। বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে সিসার দূষণ ঘটে এবং এরসঙ্গে জড়িত শিশু বা পূর্ণবয়স্ক মানুষ সীসার দূষণে শিকার হচ্ছে। ব্যাটারি ভাঙা শিল্প ছাড়াও সীসাযুক্ত রং, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, খাবার রাখার জন্য ব্যবহৃত সিরামিকের পাত্র, ই-বর্জ্য, খেলানা, সার, রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মসলা, প্রসাধনী, খাবার-দাবার এবং চাষ করা মাছের জন্য তৈরি খাবার থেকেই মূলত বাংলাদেশে সিসার দূষণ ঘটে। সিসা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স ইভাল্যুয়েশনের তথ্য অনুসারে, সিসার বিষক্রিয়াজনিত কারণে বিশ্বে যেসব দেশে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, সেই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং এদেশের জনসংখ্যার প্রত্যেকের রক্তে সিসার উপস্থিতির গড় হার ৬.৮৩ মাইক্রোগ্রাম/ডেসিলিটার, যা সর্বোচ্চহারের দিক থেকে বিশ্বে ১১ তম। এ গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশে মসলায় উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
সিসার বিষক্রিয়া শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের সক্ষমতাকে ব্যাহত করে এবং জীবনে পাওয়া সুযোগগুলোর সর্বাধিক সুবিধা গ্রহণে তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে, কারণ এটি তাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই এর ক্ষতি করে, যার ফলস্বরূপ তাদের সারা জীবনের জন্য স্নায়বিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে সিসাজনিত বিষক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা রাখে সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলোর অনানুষ্ঠানিক ও নিম্নমানের পুনর্ব্যবহার, যা ২০০০ সালের পর থেকে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যানবাহনের মালিকানা বৃদ্ধির পাশাপাশি গাড়ির ব্যাটারি পুনর্ব্যবহারবিষয়ক নিয়মকানুন ও অবকাঠামোগত ঘাটতি অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রায় ৫০ শতাংশ সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি অনিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহারে ভূমিকা রাখে। এর কারণে শিশুর আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এবং একইসঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এর আর্থিক ক্ষতি ২ হাজার ৮৬৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। সিসা শিশুদের মানসিক এবং শারীরিক উভয়দিক থেকেই ক্ষতির কারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন যে, সিসা দূষণের ফলে দেশটিতে শূন্য থেকে চার বছর বয়সি বাচ্চারা প্রায় দুই কোটি আইকিউ পয়েন্টস হারাচ্ছে।
এ ছাড়া খাবারে অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ- এরকম নানা সমস্যাও তৈরি করছে। ২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজে’র তথ্যে দেখা গিয়েছিল যে, সিসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ সিসা থেকে শিশু ও পূর্ণবয়স্কদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমশই বাড়ছে। ২০২২ সালে ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) সম্প্রতি এ গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের চার জেলায় শিশুদের রক্তে সিসার সক্রিয় উপস্থিতি মিলেছে। রক্তে সিসা থাকা শিশুদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের রক্তে এর পরিমাণ মাত্রাতিক্ত, যারা উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধবিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রা ৩ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম। টাঙ্গাইল, খুলনা, সিলেট, পটুয়াখালী- এ চার জেলার শিশুদের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। পরীক্ষার আওতায় আসা ৯৮০ শিশুর সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিশুরই রক্তে সিসার মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি নির্ধারিত মাত্রা ৩ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রামের বেশি। দুই থেকে চার বছর বয়সি শিশুদের শতভাগের শরীরেই সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বেশি থাকলে তা ক্ষতিকর বলে বিবেচিত। অন্যদিকে আইসিডিডিআর,বির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় তারা ৫০০ শিশুর রক্ত পরীক্ষা করেছে।
তাদের সবার শরীরেই সিসার উপস্থিতি মিলেছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ শিশু সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত, যা আক্রান্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে চতুর্থ অবস্থানে নিয়ে গেছে। ইউনিসেফ এবং পিওর আর্থ সিসা অ্যাসিড ব্যাটারির অনানুষ্ঠানিক পুনর্ব্যবহারসহ বিপজ্জনক পদ্ধতিগুলো বাতিল করার জন্য জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির অনানুষ্ঠানিক এবং নিম্নমানের পুনর্ব্যবহার সিসা বিষক্রিয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। আমরা সিসা দূষণের কারণগুলো জানি। এর ভয়াবহতাও এখন স্পষ্ট আমাদের মাঝে। এখনই সময় সিসা দূষণ থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় সতর্ক হই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কেকে/এআর