বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫,
২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: আন্দোলনরত শিক্ষকরা কাজে না ফিরলে আইনি ব্যবস্থা      রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইসিকে তফসিল দেওয়ার আহ্বান নাহিদের      খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে প্রধান উপদেষ্টা      অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করতে হবে : উপদেষ্টা ফরিদা      প্রবাসীরা ৬০ দিনের বেশি দেশে থাকলে ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে      এভারকেয়ারের পাশে সেনা-বিমান বাহিনীর মহড়ায় বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ      শীত নিয়ে দুঃসংবাদ দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
তারেক রহমানের দেশে ফেরার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১০:০২ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতৃত্বের প্রতীকী ও কার্যকর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা ও দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও যখন তিনি দেশে ফিরছেন না, বরং ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখছেন যে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত তার ‘একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’ তখন এটি বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি অশনি বার্তা বহন করে। প্রশ্ন উঠেছে : কেন তারেক রহমান নিজ সিদ্ধান্তে দেশে ফিরতে পারছেন না এবং সে সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেই উন্মোচিত হবে বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির জটিল আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অঙ্গনের বাস্তবতা।

প্রথমেই বলা প্রয়োজন, তারেক রহমানের এ মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এমন এক সময়ে এ কথা বলেছেন, যখন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অধীনে নতুন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতিতে রয়েছে এবং দলের অভ্যন্তরে নতুন করে আশাবাদ জন্ম নিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে, মায়ের অসুস্থতা কিংবা নির্বাচনের সম্ভাব্য ডাক উভয় কারণেই তার দেশে ফেরা অত্যাবশ্যক এবং তার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরছেন না। বরং নিজের বক্তব্যে একেবারে স্পষ্ট করে দিলেন যে, দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত তার হাতে নেই। এটি কার্যত একটি রাজনৈতিক সংকেত যে, বাংলাদেশে আজও বড় দলগুলোর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক কৌশল আন্তর্জাতিক শক্তির অদৃশ্য প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

তারেক রহমানের রাজনৈতিক যাত্রার দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ই তার ভাগ্যের মোড় ঘুরে যায়। দুর্নীতির অভিযোগে তিনি কারাগারে বন্দি হন এবং আঠারো মাস পর চিকিৎসার অজুহাতে দেশ ছাড়েন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সে সময়কার প্রেক্ষাপটে তিনি ও তার মা খালেদা জিয়া একটি গোপন সমঝোতার অংশ ছিলেন, যার আওতায় রাজনীতি থেকে সাময়িক সরে থাকার প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে মওদুদ আহমদ তার বইয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তারেক রহমান হয়তো কোনো লিখিত সম্মতিপত্রেও স্বাক্ষর করেছিলেন, যেখানে প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন না। যদি এ বক্তব্য সত্য হয়, তবে এটি তার বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

২০০৮ সালের পর থেকে তিনি লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। ২০১২ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন এবং সেটি অনুমোদিত হয়। তখন থেকে তিনি আন্তর্জাতিক আইনি সুরক্ষার আওতায় থাকা ব্যক্তি। এটি তাকে একদিকে নিরাপত্তা দিয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে বাংলাদেশের মাটিতে তার রাজনৈতিক উপস্থিতিকে আইনি ও কূটনৈতিকভাবে জটিল করেছে। যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক আশ্রয় আইনের আওতায় কেউ তার নিজ দেশে ফিরে গেলে তা আশ্রয়ের শর্ত লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হতে পারে, যদি না পরিস্থিতি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়। এখানেই আসে তার ‘একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’ কথাটির বাস্তব তাৎপর্য। হয়তো দেশে ফেরা মানেই তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের শর্ত ভঙ্গ করা- যা তাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিপদে ফেলতে পারে।

তবে বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্র এবং বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গোপন চাপ রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ১/১১-এর সময় থেকেই তারেক রহমানকে নিয়ে সন্দেহপ্রবণ ছিল। উইকিলিকসের ফাঁস হওয়া একাধিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা তাকে ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল ও অনির্ভরযোগ্য’ নেতা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ভারতের নীতিনির্ধারকরাও তাকে নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন, বিশেষত ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কারণে। ফলে আজ যখন বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন বিন্যাসে দাঁড়িয়ে আছে, তখন দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্মতি ছাড়া তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে নিরাপদ রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা সত্যিই অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।

এখানে একটি বৃহত্তর বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়- বাংলাদেশের রাজনীতি আজও অনেকাংশে বিদেশি শক্তির ইশারা ও সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দুই দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনে বিদেশ থেকে একটি খেলা চলছে’- এ মন্তব্য হয়তো একপাক্ষিক, কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিদেশি প্রভাব একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিÑউভয় দলই ক্ষমতার পালাবদলে বহিরাগত সমীকরণের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরার সিদ্ধান্তও সম্ভবত একটি বৃহৎ কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশের অংশ, যা শুধু পারিবারিক আবেগ বা রাজনৈতিক তাগিদ দ্বারা নির্ধারিত হয় না।

তবে প্রশ্ন জাগে- শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও কেন তাকে ফিরতে দেওয়া হল না, কিংবা তিনি কেন ফিরছেন না? এখানে দুটি সম্ভাবনা বিষয় বিবেচ্য। প্রথমত, আন্তর্জাতিক পরামর্শ বা চাপে তিনি আপাতত অপেক্ষা করছেন, কারণ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক কাঠামো এখনো স্থিতিশীল নয়। দ্বিতীয়ত, বিএনপির অভ্যন্তরেও তার দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে কিছু অনিশ্চয়তা থাকতে পারেÑযেমন নেতৃত্বের ভারসাম্য, সাংগঠনিক সমন্বয়, এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি।

এ অবস্থায় তার দেশে না ফেরা দলের জন্য যেমন বিভ্রান্তিকর, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য সুবিধাজনক। কারণ রাজনীতিতে অনুপস্থিত নেতার ওপর নির্ভরশীলতা কখনোই সংগঠনের শক্তি জোগায় না; বরং অনিশ্চয়তা তৈরি করে। বিএনপি নেতৃত্ব এখন বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই তিনি দেশে ফিরবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- যে ব্যক্তি এক দশক ধরে লন্ডনে, তিনি কি নির্বাচনের সময় হঠাৎ ফিরে এসে নেতৃত্ব দিতে পারবেন? এ প্রশ্নের উত্তর অনিশ্চিত।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিতর্কের আরেকটি দিক হলো জনমত ও সামাজিক অনুভূতির প্রতিক্রিয়া। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মধ্যে সহানুভূতির আবেগ জেগেছে এবং সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই বলেছেন- এমন সময়ে মায়ের পাশে দাঁড়ানোই সন্তানের কর্তব্য। এ আবেগপূর্ণ আহ্বান বিএনপির জন্য একটি নৈতিক চাপ তৈরি করেছে। কিন্তু তারেক রহমানের ফেসবুক স্ট্যাটাস সেই আবেগকে প্রশমিত না করে বরং নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এখন প্রশ্ন করছেন- যদি এখনো তার সিদ্ধান্ত বিদেশ নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে, তবে তিনি ভবিষ্যতে কতটা স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন?

এ প্রেক্ষাপটে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বা তার পরিণত রূপ ‘মাইনাস ফোর’ তত্ত্বের পুনরুত্থানও লক্ষণীয়। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সেটি মূলত দুই পরিবারের রাজনীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বাস্তবে তার বিপরীতই ঘটেছিল। আজ আবার যখন শেখ হাসিনা রাজনৈতিকভাবে প্রস্থান করেছেন এবং খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অক্ষম, তখন অনেকেই দেখছেন- তারেক রহমানের দেশে ফেরার অনিশ্চয়তা সেই পুরোনো সূত্রকে পুনরুজ্জীবিত করছে। অর্থাৎ ‘মাইনাস টু’ এখন ‘মাইনাস ফোর’-এর পথে এগোচ্ছে।

তবে এ সমীকরণের মধ্যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কোথায়? দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতি ব্যক্তিনির্ভর, আদর্শ নয়। তারেক রহমানের ফেরা, না ফেরা সেই ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতির সীমাবদ্ধতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। তিনি যদি সত্যিই জনগণের নেতৃত্বে ফিরতে চান, তবে তাকে এ অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের জাল ভেঙে রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অন্যথায়, তার নেতৃত্বে বিএনপির গণআস্থার পুনরুদ্ধার কঠিন হবে।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকে যায়- তারেক রহমান কবে আসবেন? নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর, নাকি রাজনৈতিক সমঝোতা সুনির্দিষ্ট হলে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, তার অনুপস্থিতি বিএনপির নেতৃত্বে এক ধরনের ‘ভার্চুয়াল শূন্যতা’ তৈরি করছে। তার এ অনিশ্চয়তা দলকে যেমন বিভ্রান্ত করছে, তেমনি জাতির কাছে একটি বার্তা তুলে ধরছে- বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন নয়। দেশ স্বাধীন হলেও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বহুমাত্রিক চাপের কাছে বন্দি।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই নিয়ন্ত্রণের রেখা অতিক্রম করা। তারেক রহমানের দেশে ফেরা যেমন একজন অত্যাবশ্যকীয় নেতার প্রত্যাবর্তন হবে, তেমনি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণের দৃষ্টান্তও হবে। বাংলাদেশ কি সত্যিই নিজের নিয়ন্ত্রণে ফিরতে পারবে, না কি বিদেশি প্রভাব ও অতীতের চুক্তির বেড়াজালেই আবদ্ধ থাকবে?- এ প্রশ্নের উত্তরও নিহিত তার এ সিদ্ধান্তের মধ্যেই।

লেখক : চিকিৎসক, ছড়াকার ও কলামিস্ট

কেকে/এআর
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হামজা-শমিতদের ম্যাচ থেকে ৪ কোটির বেশি আয় বাফুফের
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে যোগ দিলেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩
দশমিনায় মৎস্য মেরিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ

সর্বাধিক পঠিত

বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে প্রার্থনা সভা
সাভারে টিভি সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরসি'র আত্মপ্রকাশ
ফটিকছড়িতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান
চিরিরবন্দরে বাস–ভ্যান সংঘর্ষে নিহত ২
বিএনপি নেতার পুকুরে বিষপ্রয়োগ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close