জুলাই সনদের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে গতকাল শুক্রবার বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে এ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শুরু হয়। ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের এ অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে তাদের মতো করে আন্তরিক আচরণ করেছে। কিন্তু এটাও আমরা খেয়াল করছি, সংস্কারের পরিমাণ, ব্যাপ্তি এবং সেটার বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর বিতর্কের অবসান হয়নি। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি এনসিপি, তারপরও দীর্ঘ বিভাজন, অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের রাজনীতির মধ্যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ ২৫টি রাজনৈতিক দল এ সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যের স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এ স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? বা বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সে বিষয়ক সুস্পষ্ট রূপরেখা এখনো দেখা যায়নি। সনদে স্বাক্ষরকারীরা গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার ও জনগণের অংশগ্রহণের অঙ্গীকার করেছেন। অথচ বাস্তবায়নের কাঠামো বা আইনি ভিত্তি নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
ফলে সনদটি আপাতত একটি রাজনৈতিক ঘোষণা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী হাসনাত কাইয়ুম যথার্থই বলেছেন—‘গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ইস্যুতে সনদে বাস্তবায়ন পদ্ধতি অনুপস্থিত।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, বাস্তবায়নের রূপরেখা সরকার নির্ধারণ করবে। এ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যেমন আছে, তেমনি ঝুঁকিও কম নয়। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যদি সরকারনির্ভর হয়ে পড়ে, তবে সনদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
এদিকে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি নেওয়ার প্রস্তাব গণতান্ত্রিকভাবে প্রশংসনীয়। কিন্তু ‘কবে, কীভাবে এবং কোন বিষয়ের ওপর গণভোট হবে’—এ মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো অনিশ্চিত। কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজন করা হোক, আবার কেউ বলছেন, আগে গণভোট হোক, তারপর নির্বাচন। এ মতবিরোধই প্রমাণ করে—রাজনৈতিক ঐক্য কাগজে যতটা সহজ, বাস্তবে তা ততটাই জটিল।
জুলাই সনদের মূল সাফল্য হলো রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার টেবিলে ফেরা। কিন্তু এর ব্যর্থতা হবে, যদি সনদটি শুধু একটি প্রতীকী অনুষ্ঠান হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে। গণভোট আয়োজন, জনগণের অংশগ্রহণ ও আইনি ভিত্তি নির্ধারণ—এ তিনটি পদক্ষেপ ছাড়া জুলাই সনদ কখনোই বাস্তব রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। সেদিক থেকে বিএনপির প্রস্তাবনা ছিল নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা এতে সময় এবং অর্থের দুয়েরই শাস্রয় হবে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কম হবে। ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি যেভাবে আলোচনা করেছে, তাতে যৌক্তিকভাবেই মনে হয় যতটুকু সংস্কারের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়েছে, সেটুকু তারা নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন করবে। জনগণ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হবে না হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়া জনগণের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনে।
জুলাই সনদে স্বাক্ষর আমাদের সেই কল্যাণের পথই দেখাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক সংস্কারের রাষ্ট্রকাঠামো অর্জন করার অপেক্ষায় দেশের মানুষ। সেই রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমেই যাত্রা শুরু হবে নতুন বাংলাদেশের। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্মিত হবে। রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় থাকবে। এখন দেশের নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও তরুণ প্রজন্ম অপেক্ষায়—এ সনদ আসলেই কতটুকু বাস্তবায়িত হবে? নতুন সূর্যোদয়ের বার্তা নিয়ে এই সনদ যেন আরেকটি কাগুজে প্রতিশ্রুতির জন্ম না দেয়। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে এ সনদ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করা। অন্যথায় সময়ই বলে দিবে, জুলাই সনদ ইতিহাসে জায়গা পাবে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে, না অমীমাংসিত অধ্যায়ের শব্দহীন নথি হয়ে।
কেকে/এজে