বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন এখন রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দুতে। মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া (ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা), দেড় হাজার টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার দাবি নিয়ে তারা টানা চার দিন ধরে রাজপথে। শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, শহীদ মিনার এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়ানো এই শিক্ষকরা দাবি আদায় করতে গিয়ে মার খেয়েছেন, হতে হয়েছে জেল জুলুমের শিকার। তবু তারা পিছু হটছেন না।
দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা নানা বৈষম্যের শিকার। সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। ফলে বর্তমান বাজারদরে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ঢাকার মতো শহরে যেখানে এক রুমের ভাড়া ১৫-২০ হাজার টাকায় পৌঁছেছে, সেখানে ১৬ হাজার টাকার বেতন পাওয়া একজন শিক্ষক কীভাবে সংসার চালাবেন, সেটাই বড় প্রশ্ন।
শিক্ষক সমাজের এ বাস্তবতা শুধু তাদের ব্যক্তিগত দুর্ভোগ নয় এটি শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার মান ক্রমশ তলানীতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের চলতি বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে বলা হয়, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে (প্রথম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)।
কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা শেখার মান বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ৬.৫ বছরের সমতুল্য। অর্থাৎ শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মানে বাংলাদেশ অন্তত ৪.৫ বছর পিছিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশার একটি বড় কারণ হলো শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। শিক্ষকরা বহু বছর ধরেই অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার। একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষকতা করে চালাতে পারছেনা সংসার, একটু বাড়তি আয়ের জন্য যুক্ত হতে হচ্ছে অন্য পেশায় ফলে এর কুফল ভোগ করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে সরকারের অবস্থানও এখনো অস্পষ্ট। অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদেশে থাকায় সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠালেও কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অথচ শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে শিক্ষাবর্ষের শেষ প্রান্তে এসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষকরা যখন রাস্তায়, শিক্ষার্থীরা তখন শ্রেণিকক্ষের বাইরে এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাজেট বাস্তবায়ন চলমান থাকায় বড় ব্যয় অনুমোদনে কিছু জটিলতা থাকতে পারে, এটি সত্য। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার মানুষদের ন্যায্য দাবি বারবার উপেক্ষা করা রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর।
শিক্ষকরা কোনো বিলাসিতা চান না; তারা চান শিক্ষকতা হোক সম্মানজনক জীবিকা, যাতে তারা নিশ্চিন্তে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে মনোযোগী হতে পারেন। সরকার যদি এখনই গঠনমূলক সিদ্ধান্ত না নেয়, তবে এ আন্দোলন আরো বিস্তৃত হবে এবং তার প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের ওপর। তাই প্রয়োজন দ্রুত ও আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে শিক্ষকদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে একটি বাস্তবসম্মত সমাধান। শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা করা মানে শুধু তাদের দাবি পূরণ করা নয়; এটি জাতির ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকাশও বটে।
কেকে/ এমএস