চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। দেশের ৯০ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এই বন্দর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ বিরাজ করছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া, নিউ মুরিং ও ঢাকার পানগাঁও টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার চুক্তি আগামী ডিসেম্বরে স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে লালদিয়া টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য, বাকি দুটি ২৫ বছরের মেয়াদে বিদেশি কোম্পানির হাতে পরিচালিত হবে।
এ সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের যুক্তি হলো-দক্ষ পরিচালনা, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। ২০২০ সালে নিয়োগকৃত বিদেশি কনসালটেন্টের সুপারিশে বন্দর ট্যারিফ বাড়ানোও এই প্রক্রিয়ারই অংশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এ ট্যারিফ পুনর্গঠন ও অপারেটর নিয়োগ কতটা দেশের স্বার্থে, আর কতটা বিদেশি বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষায়? বন্দর অনেক লাভ নিয়ে চললেও এসব বিদেশি কোম্পানির অধিক মুনাফাবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য চুক্তির আগে সরকার নিজেই সকল মাশুল বৃদ্ধি করেছে ৪০ শতাংশের বেশি। এতে সব জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর আরেক দফা আক্রমণ আসবে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমবে।
কাস্টমস-আমলাতন্ত্র-যোগাযোগ ঠিক না করে, জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনযোগী না হয়ে বন্দরের পরিচালনা কর্তৃত্ব কোনো দরপত্র ছাড়া নির্দিষ্ট কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেন বদ্ধপরিকর? এই কাজের জন্য প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন সমালোচকদের হুমকি দিয়ে কথা বলছেন। পুলিশ দিয়ে সভা সমাবেশ বন্ধ করছেন। আরেকটি খেয়াল করার বিষয়- এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সীদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের সুবিধা-অসুবিধার মূল্যায়ন না করে সরকার যখন দ্রততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে তখন প্রায় প্রতিদিন সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সভায় দরকষাকষিতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। তারা এই জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজে মহানীরব। সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তাদের কোনো মূল্যায়ন নেই। প্রশ্নও নেই।
আরেকটি বিষয় হলো- নতুন ট্যারিফ কাঠামো বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসি’র প্রস্তাবিত মডেলের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। আইএফসি নিজেই স্বীকার করেছে যে, বাংলাদেশের ‘কঠোর ট্যারিফ নীতি’ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে, তাই তারা “ট্যারিফ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা” চেয়েছিল। সরকার সেই পরামর্শ বাস্তবায়ন করেছে।
এর ফলে একদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বেড়েছে, অন্যদিকে বিদেশি অপারেটরদের জন্য বাজার হয়েছে “আর্থিকভাবে আকর্ষণীয়”। এর সুফল সত্যিই দেশীয় বাণিজ্য ও সাধারণ আমদানি-রপ্তানিকারকের কাছে পৌঁছাবে, নাকি এর বড় অংশ চলে যাবে আন্তর্জাতিক করপোরেটদের মুনাফার ঘরে- এই প্রশ্নই এখন মুখ্য।
ইতোমধ্যেই পতেঙ্গা টার্মিনাল পরিচালনা করছে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই)। আর নিউ মুরিং টার্মিনালের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড, যা এককভাবে বন্দরের মোট কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। লালদিয়া টার্মিনাল নিয়েও আগ্রহ দেখিয়েছে ডেনমার্কের এপি. মোলার মায়েরস্ক। এভাবে একে একে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলো বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে- এটি কি বিনিয়োগবান্ধব উন্নয়ন, নাকি নীতিগত নির্ভরতার এক নতুন পর্ব?
নিঃসন্দেহে, বিদেশি বিনিয়োগ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা দেশের জন্য দরকার। কিন্তু সেই বিনিয়োগ যেন দেশের নিজস্ব সক্ষমতা, নীতিগত স্বাধীনতা ও ভবিষ্যৎ রাজস্ব আয়কে ক্ষতিগ্রস্ত না করে-এখানে ভারসাম্য রক্ষা কিভাবে করা হবে সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়নি। সরকার বিদেশি অপারেটরদের হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা তুলে দিলে, সেটি জাতীয় স্বার্থ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করবে সে বিষয়ে পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। বন্দর যেন শুধু ব্যবসায়িক মুনাফার উৎস না হয়ে ওঠে, বরং জাতীয় অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের সহায়ক হয়- অন্তর্বর্তী সরকারকে এটি নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে।
কেকে/ এমএস