বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫,
৩১ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও নিচে জিপিএ-৫      ২০২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই ফেল      এইচএসসির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, পাসের হার ৫৮.৮৩%      ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন আজ      সরকারের ভেতর ‘গুপ্তচর’      ১৬ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি দেখে নিন      মধ্যরাতে হাসপাতালে ভর্তি হলেন খালেদা জিয়া      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
বিচারের মোড়কে রাজনীতি : সংস্কৃতি ও সাহিত্যের কুতর্কের দোকান
রাফসান আহমেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫, ৯:৪৬ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শুনতে গিয়ে যে সংশয় জন্ম নেয়, তা কেবল আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রে আঘাত করে। যে বিচারিক মঞ্চের মূল লক্ষ্য ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো সুনির্দিষ্ট ও ভয়াবহ নৃশংসতার নিষ্পত্তি করা, সেখানে যখন ১৬ বছরের একটি সরকারের সামগ্রিক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, এবং রাজনৈতিক ভুল-ত্রুটি প্রাধান্য পায়, তখন অনিবার্যভাবে প্রশ্ন ওঠে- এই প্রক্রিয়া কি সুবিচার প্রতিষ্ঠা করছে, নাকি কেবল রাজনৈতিক প্রতিশোধের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?

পর্যবেক্ষণ অনুসারে, রাষ্ট্রপক্ষ যখন গুম, অপহরণ এবং সুনির্দিষ্ট নৃশংসতার অভিযোগ এনেছে, সেটুকু এই ট্রাইব্যুনালের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু আইনি যুক্তির সেই পথটি ছেড়ে যখন রাষ্ট্রপক্ষ পেঁয়াজ আমদানি, চালের দামের ওঠানামা, ব্যাংকিং ব্যর্থতা, এমনকি সাংস্কৃতিক উৎসবের মতো বিষয়গুলো মিলিয়ে ফেলে-তখন বিচারিক নিরপেক্ষতার সীমারেখাটি অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং ট্রাইব্যুনালের মৌলিক ম্যান্ডেট থেকে বিচ্যুতি ঘটে। এই মিশ্রণ ইঙ্গিত দেয় যে, ট্রাইব্যুনালটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচারের চেয়ে একটি রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করার একটি প্রক্রিয়ায় পরিণত হতে চাইছে।

সাহিত্য, ইতিহাস এবং আইনি প্রমাণ : যখন ‘সত্য’ বিলীন হয়

বাংলাদেশের আইনি ও ঐতিহাসিক পরিমণ্ডলের এক মারাত্মক দুর্বলতা এই ট্রাইব্যুনালের বিতর্কেও প্রকট হয়েছে। অতীতে যেমন শাহরিয়ার কবিরের ‘ক্রাচের কর্নেল’ অথবা মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’কে ঐতিহাসিক প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহারের রাজনৈতিক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তেমনি ট্রাইব্যুনালের যুক্তিতর্কেও সেই একই বিপজ্জনক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

তথ্যমতে, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দেয়াল’-কে এই বিচারিক প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের বই হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি কেবল ‘ভুল’ নয়, এটি আইনি প্রক্রিয়ার একটি গুরুতর নৈতিক ও পদ্ধতিগত স্খলন। একটি উপন্যাস, যার ভিত্তি আবেগ, ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা ও কাল্পনিক চরিত্রায়ন, তা কখনোই আইনি প্রমাণের কঠোর মানদণ্ড পূরণ করতে পারে না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন সাক্ষ্য, দলিল এবং নিরপেক্ষ তথ্য। সাহিত্যকে আইনি সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা হলে- বিচারের ন্যায্যতা এবং আইনি নিরপেক্ষতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং এটি বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা পক্ষপাতিত্বের হাতিয়ারে পরিণত করার পথ প্রশস্ত করে। সাহিত্য যখন ইতিহাসের জায়গা দখল করে, তখন সমালোচনামূলক চিন্তা এবং ঐতিহাসিক প্রমাণের নিরপেক্ষ যাচাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সংস্কৃতির ওপর আঘাত, ‘আকিদা’ বনাম অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয় : 

এই যুক্তিতর্কের সবচেয়ে বিস্ফোরক এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর দিকটি ছিল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর সরাসরি আক্রমণ। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুলী পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে ‘ঐতিহ্যের অংশ নয়’ বলে আখ্যা দেওয়া এবং সেই সঙ্গে এই উৎসবকে ‘আকিদা’ বা জাতির আধ্যাত্মিক ভিত্তির বিরুদ্ধে কাজ হিসেবে তুলে ধরা-একটি ভুল ব্যাখ্যা নয়, এটি আমাদের  বহুত্ববাদী অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র চেতনার প্রতি একটি সরাসরি চ্যালেঞ্জ।

পহেলা বৈশাখ হাজার বছর ধরে এ ভূখণ্ডের মানুষের প্রাণের উৎসব, যা ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ঘোচায় এবং সর্বজনীন পরিচয়কে সুসংহত করে। এই উৎসবকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অর্থ হলো, একটি জাতিসত্তার মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করা এবং দেশকে একটি সংকীর্ণ, কট্টরপন্থি ধর্মীয় আইডেন্টিটির ফ্রেমে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা।

বৈশাখী উৎসব ও সাংস্কৃতিক যাপনে আক্রমণ করার প্রবণতা নতুন নয়। আমরা অতীতে দেখেছি : রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ভয়াবহ হামলা (২০০১), উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সমাবেশে হামলা (১৯৯৯)।

এই হামলাগুলো ছিল সাংস্কৃতিক উদারতার ওপর সরাসরি আঘাত। জুলাই-পরবর্তী সময়ে এ ধারাই এখন আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গানের শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা, মাজারে হামলা, ভাস্কর্য ও কনসার্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা- এগুলো সবই ইঙ্গিত দেয় যে, একটি কট্টরপন্থি ধারা দেশের সুফি, লোকায়ত ও মুক্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নির্মূল করতে চাইছে। যখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনি যুক্তি ও এই গোঁড়ামির পথকে দালিলিক বৈধতা দেয়, তখন অসহিঞ্চুতার পরিবেশ আরো তীব্র হয়।

জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে এই কট্টর গোঁড়ামি কেবল আদালতের যুক্তিতর্কে সীমাবদ্ধ নয়; এটি জনজীবনেও ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন- মাজারে হামলা, ভাস্কর্য ও ম্যুরালে আক্রমণের প্রচেষ্টা, কনসার্ট বন্ধ করা, এবং ফকিরদের ওপর নিপীড়ন- এগুলো সবই এক গভীর সাংস্কৃতিক সংকটের ইঙ্গিত। এই আক্রমণগুলো দেশের সুফি, লোকায়ত, এবং সহনশীল আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে নির্মূল করতে চাইছে। এই ধরনের সাংস্কৃতিক দমন প্রকারান্তরে মুক্তচিন্তা, শিল্পকলা এবং জাতীয় ইতিহাসকে অস্বীকার করে একটি পশ্চাৎপদ ও রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক কাঠামো তৈরির দিকে চালিত করছে।

সেক্যুলার যুক্তির দুর্বলতা ও লিঙ্গ-সহিংসতা

এই কঠিন সময়ে উদারপন্থী শক্তির সমালোচনা ও প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। যখন রাষ্ট্রপক্ষের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রতিষ্ঠানও দেশের সর্বজনীন উৎসবকে ‘আকীদার বিরুদ্ধে’ বলে আখ্যা দেয়, তখন উদারপন্থি শক্তিগুলো জনপরিসরে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এটি প্রকারান্তরে কঠোর ধর্মীয় ব্যাখ্যার দ্বারা চালিত রাজনীতির পথকে প্রশস্ত করে এবং সামাজিক মেরুকরণকে আরো তীব্র করে।

অন্যদিকে, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি একটি গভীর সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত। এটি শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি নয়, এটি একটি পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন, যা নারী স্বাধীনতা এবং লিঙ্গ সমতার মতো আধুনিক মূল্যবোধগুলোকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। এই মূল্যবোধ নারীকে জনপরিসর থেকে সরিয়ে দিতে চায় এবং নারীর প্রতি সহিংসতাকে এক ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়।

এছাড়াও, ড. জাফর ইকবালের গল্পের প্রসঙ্গে ‘রাজাকারকে ঘৃণা করা যাবে না’ এমন ইঙ্গিত দেওয়া আইনি বিতর্কের লক্ষ্য থেকে গুরুতর বিচ্যুতি এবং একটি অস্বস্তিকর আদর্শিক বার্তা দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, ট্রাইব্যুনালের মূল মনোযোগ সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচারের চেয়ে একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিপক্ষকে এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতার পাঠকে সামগ্রিকভাবে আক্রমণ করার দিকে নিবদ্ধ।

সুবিচারের পথে চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের পথ

জুলাই-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই পরিস্থিতি দেশের আইনি ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ, অথবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার উপকরণ হিসেবে সমালোচিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে।

হাজার হাজার জীবনের রক্তের বিনিময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে  ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে একে অবশ্যই গোষ্ঠী স্বার্থের রাজনীতি, প্রতিশোধের আকাক্সক্ষা এবং সাংস্কৃতিক গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। সুবিচার কেবল তখনই সম্ভব, যখন বিচার প্রক্রিয়া তার আসল লক্ষ্য- মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- থেকে সরে না যায়। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বা রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিচার সেইসব প্রতিষ্ঠানের কাজ, যাদের জন্য তা তৈরি হয়েছে। 

অর্থনৈতিক দুর্নীতি, পেঁয়াজ আমদানি বা শেয়ার বাজারের মতো অভিযোগের বিচার করার জন্য দেশে ফৌজদারি আদালত ও দুদক রয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত বিষয়কে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে এক করে ফেলা হলে, তা ট্রাইব্যুনালের মৌলিক বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করে। সর্বপোরি, সব কিছুকে এক ট্রাইব্যুনালে এনে ফেলা ন্যায়বিচারের গুরুত্বকে হ্রাস করে এবং এটিকে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করে।

সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট বিচারই পারে এই ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা রক্ষা করতে। বিচারের মোহে ইতিহাসকে বিকৃত করা বা সংস্কৃতিকে শত্রু বানানোর এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের উদার গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনা। সুবিচার যেন রাজনৈতিক পোশাকে না আসে, বরং নিরপেক্ষতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়- জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এটিই কাম্য।

লেখক : নৃবিজ্ঞানী, দক্ষিণ এশীয় বিষয়ক গবেষক ও চলচ্চিত্রকার

কেকে/ এমএস
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবো না: নাহিদ
ঈশ্বরদীর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আটক
এইচএসসির ফল বিপর্যয়, সিলেট বোর্ডে অর্ধেকই ফেল
বুড়িচংয়ে একাধিক মামলার আসামি ছাত্রলীগ নেতা শামীম গ্রেফতার
শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে কাজ করছে সরকার: শিক্ষা উপদেষ্টা

সর্বাধিক পঠিত

এইচএসসির পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, পাসের হার ৫৮.৮৩%
সরকারের ভেতর ‘গুপ্তচর’
চাকসু নির্বাচন : চারুকলার হোস্টেলের ফল ঘোষণা—ছাত্রদল এগিয়ে
সকাল ১০টায় এইচএসসির ফল, জানা যাবে তিনভাবে
নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণা করা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close