আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান, চার দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা এবং সম্ভাব্য সহিংসতার আশঙ্কা—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক অস্থির পরিস্থিতি। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে বিনিয়োগ, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের ওপর। রাজনৈতিক অস্থিরতা সবসময়ই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন ক্রয়াদেশ দিতে অনীহা দেখাচ্ছেন। গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্প খাতে উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়েছে, অনেক কারখানায় কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন বিনিয়োগ কার্যত স্থবির। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট, অন্যদিকে ঋণের উচ্চ সুদহার—সব মিলিয়ে উদ্যোক্তারা দিশাহারা। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও এই উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা যায়। সংস্থাটি বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতা এসেছে এবং তা অর্থনীতির সামগ্রিক গতিকে মন্থর করছে। প্রতিষ্ঠানটির মতে, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে এই অনিশ্চয়তা কেটে যাবে এবং অর্থনীতি ধীরে ধীরে গতি ফিরে পাবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। বিনিয়োগকারীরা সবসময় এমন একটি পরিবেশ খোঁজেন, যেখানে নীতি ও সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা থাকে, এবং হঠাৎ কোনো রাজনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়তে হয় না। কিন্তু নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা, আন্দোলন, সহিংসতা বা প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার কারণে সেই আস্থা নষ্ট হয়েছে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরে সম্প্রতি ২৩টি সেবা খাতে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়েছে। এতে কনটেইনার পরিবহনের খরচ বেড়েছে, আমদানি ও রপ্তানির পণ্যমূল্যও বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এর চাপ পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর—পণ্যের দাম বাড়বে, বাজারে অস্থিরতা বাড়বে। ব্যবসায়ীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত বর্তমান সংকটকে আরো প্রলম্বিত করবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কবৃদ্ধির প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতও সংকটের সম্মুখীন। টানা দুই মাস ধরে রপ্তানি আয় কমছে। বিদেশি ক্রেতারা নতুন ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন না, বরং অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছেন। বর্তমান সময়ের এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে রপ্তানির গতি আরো কমে যেতে পারে। অর্থনীতির এ দুরবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে, বাজারে স্থিরতা আসবে এবং অর্থনীতি আবারো গতি ফিরে পাবে। কিন্তু নির্বাচন বিলম্বিত হলে বা সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে অর্থনৈতিক ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের আজ সবচেয়ে বড় চাওয়া—একটি স্থিতিশীল পরিবেশ। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে তাই এখনই সংযম ও দূরদৃষ্টি প্রদর্শন করতে হবে। নিজেদের দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের অর্থনীতি ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে আবার গতিশীল করতে।
কেকে/এজে