চার দশক আগে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং সীমিত পরিসরে শুরু হলেও আজ তা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে এই খাত, যা এখন ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৬৯৯টি শাখা এবং প্রচলিত ব্যাংকের ৯ শত ৪৬টি ইসলামী শাখা ও উইন্ডোর এক বিস্তৃত পরিসর। সম্মিলিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠান দেশের মোট ব্যাংক আমানতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিচালনা করছে। ফলে ইসলামী ব্যাংকিং এখন আর কোনো প্রান্তিক ধারণা নয়; এটি বাংলাদেশের মূলধারার আর্থিক বাস্তবতা। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্রুত প্রসার শুধু ধর্মীয় অনুপ্রেরণা বা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়; বরং এটি সমাজের সাধারণ মানুষের শরিয়াহসম্মত আর্থিক সমাধানের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বাস্তব প্রতিফলন। তবে বিগত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থপাচার ও পাহাড় সমান খেলাপি ঋণের কারণে এই খাত এখন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বাস, অর্থনীতি ও পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট
ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রাথমিক উত্থান ছিল বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোতে বিভিন্ন অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.৪৭ ট্রিলিয়ন টাকা, যা তাদের মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ। অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবস্থাও সুখকর নয়। চলমান সংকট শুধু একটি আর্থিক সংকট নয়; বরং এটি শরিয়াহ পরিপালন ও সুশাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মৌলিক ভিত্তির ওপর এক কঠোর আঘাত। এর ফলে বহু গ্রাহক, যারা একসময় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের প্রতি অনুগত ছিলেন, তারা এখন অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ ও পেশাদারভাবে পরিচালিত প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী উইন্ডো বা শাখাগুলোর দিকে ঝুঁকছেন। সরকার সম্প্রতি এই পাঁচটি দুরবস্থাগ্রস্ত ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এটি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণে নয়; বরং ন্যায়, স্বচ্ছতা ও আস্থার মতো ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মৌলিক মূল্যবোধ রক্ষায় সামষ্টিক ব্যর্থতার কারণে ইসলামী ব্যাংকিং খাত আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ।
সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে প্রচলিত ব্যাংকগুলো
যখন ইসলামী ব্যাংকগুলো আস্থার সংকটে ভুগছে, তখন প্রচলিত ব্যাংকগুলো দ্রুত তাদের ইসলামী ব্যাংকিং সেবা ও কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ইসলামী শাখার সংখ্যা ৩৪ থেকে বেড়ে ৪১ এবং ইসলামী উইন্ডোর সংখ্যা ৭৩০-৯১৯-এ পৌঁছেছে। আরো অনেকগুলো প্রচলিত ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো খোলার অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকে আবেদন করেছে। এ ছাড়া তিনটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক—এনসিসি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
এটি প্রমাণ করে যে ইসলামী অর্থায়ন এখন শুধু কিছু ধর্মপরায়ন মানুষের ব্যাংকিং চাহিদা নয়, বরং দেশের মূলধারার আর্থিক চাহিদা। এই রূপান্তর আরো একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে—শুধু ‘ইসলামী’ নামের লেবেল যথেষ্ট নয়; বরং প্রকৃত শরিয়াহ পরিপালন, শক্তিশালী সুশাসন ও বিশ্বাসযোগ্যতাই এখন সাফল্যের আসল মাপকাঠি।
আমানত প্রবাহ ও আস্থার পুনরুদ্ধার
সম্প্রতি অস্থিরতা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
— ইসলামী ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৫৭ লাখ কোটি টাকা, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৩.২২ শতাংশ এবং আগের বছরের তুলনায় ২.৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
— এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ৩.৯৭ লাখ কোটি টাকা, প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী শাখায় ২৫ হাজার ৩৩৩ কোটি এবং ইসলামী উইন্ডোতে ৩৪ হাজার ৮৩ কোটি টাকা।
— ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের মোট আমানতের ২৪.৩৫ শতাংশ এবং মোট বিনিয়োগের ২৯.১৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
— ২০২৫ সালের মার্চের ৩.৬ কোটি থেকে জুনে আমানত হিসাব বেড়ে হয়েছে ৩.৯ কোটি।
ইসলামী ব্যাংক খাতের আমানতের এ প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি জনগণের বিশ্বাস পুরোপুরি নষ্ট হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় তদারকি, তারল্য সহায়তা ও বোর্ড পুনর্গঠন খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছে। অনেক গ্রাহক এখন প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী প্রোডাক্ট ও সেবাসমূহ গ্রহণ করলেও, এটি ইসলামী ব্যাংকিং থেকে বিমুখতা নয়; বরং শরিয়াহ অনুগত ব্যাংকিংয়ের প্রতি জনগণের বিশ্বাসেরই নতুন রূপ।
অতিক্রমযোগ্য চ্যালেঞ্জসমূহ
ইসলামী ব্যাংকিং খাতের পূর্ণ বিকাশে নিম্নোক্ত দুর্বলতাগুলোর সমাধান অপরিহার্য:
— দুর্বল করপোরেট গভর্নেন্স: রাজনৈতিক প্রভাব, আত্মীয়করণ ও অপেশাদার ব্যবস্থাপনা।
— শরিয়াহ লঙ্ঘন: অভিন্ন ব্যাখ্যার অভাব ও দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কারণে আস্থা হ্রাস।
— সীমিত পণ্য বৈচিত্র্য: মুরাবাহা ও বাই-মুয়াজ্জাল নির্ভরতা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।
— তারল্য ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ঘাটতি: ইসলামি মানি মার্কেটের অভাব স্বল্পমেয়াদি তহবিল ব্যবস্থায় বাধা।
— ইসলামী ব্যাংকিংবিষয়ক জ্ঞানের অভাব: দক্ষ ইসলামী ব্যাংকার গড়ে তুলতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব।
উদীয়মান সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র
বর্তমান চ্যালেঞ্জের মাঝেও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা আশাব্যঞ্জক, বিশেষত নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে:
— ইসলামী মাইক্রোফাইন্যান্স ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন: ক্বারজে হাসান, মুশারাকা ও মুদারাবাভিত্তিক ক্ষুদ্র অর্থায়ন মডেল গ্রামীণ উদ্যোক্তা, কৃষক ও নারী-নেতৃত্বাধীন ব্যবসাকে সহায়তা করতে পারে।
— টেকসই ও নৈতিক অর্থায়ন: শরিয়াহ নীতি টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি ও সামাজিক প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ায় ‘গ্রিন ফাইন্যান্স’-এর নেতৃত্ব নিতে পারে।
— ডিজিটাল ইসলামী ব্যাংকিং সেবা: মোবাইল ও ফিনটেক নির্ভর শরিয়াহসম্মত ব্যাংকিং তরুণ প্রজন্ম ও প্রবাসী গ্রাহকদের সহজে পৌঁছাতে পারবে।
— সুকুক ও মূলধন বাজার উন্নয়ন: সরকারি ও করপোরেট সুকুক ইস্যু করলে সুদমুক্ত বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যা তারল্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়ক।
— আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে শরিয়াহ গভর্নেন্স, তারল্য ব্যবস্থাপনা ও ফিনটেক উদ্ভাবনে দক্ষতা অর্জন সম্ভব।
নীতিগত সংস্কারের প্রস্তাবনা
ইসলামী ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারে জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন:
— করপোরেট গভর্নেন্স শক্তিশালীকরণ: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, মেধাভিত্তিক ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব নিশ্চিত করা।
— স্বাধীন শরিয়াহ অডিট ও প্রতিবেদন প্রকাশ: বার্ষিক বাহ্যিক শরিয়াহ অডিট বাধ্যতামূলক করা এবং ফলাফল প্রকাশ করা।
— প্রকৃত রূপান্তর নিশ্চিতকরণ: প্রচলিত ব্যাংকগুলোর পূর্ণ ইসলামী রূপান্তরে বাস্তব রোডম্যাপ ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা থাকতে হবে।
— জনআস্থা বৃদ্ধি: নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ব্যাংকসমূহের যৌথ প্রচারণায় আমানত সুরক্ষা ও চলমান সংস্কার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা।
— মানবসম্পদ উন্নয়ন: শরিয়াহ গভর্নেন্স, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ইসলামী ফাইন্যান্সে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।
আগামীর সম্ভাবনা পথ
বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং এখন নৈতিক পুনর্জাগরণের এক সন্ধিক্ষণে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ সাময়িক স্থিতি আনলেও তখনই কেবল প্রকৃত পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে যখন ইসলামী ব্যাংক খাতটি তার মৌলিক নীতিমালা যেমন ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা, কল্যাণ ও আস্থা পুনরায় ধারণ করবে।
পরিশেষে বলা যায়, সংস্কার ও সুশাসন বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী অর্থব্যবস্থার এক আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ভবিষ্যতের ইসলামী ব্যাংকিং কেবল টিকে থাকার লড়াই নয় বরং এটি নীতিমালা বাস্তবায়নের কঠিন পরীক্ষা। প্রকৃত শরিয়াহ পরিপালন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ব্যাংকই শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস, যোগ্যতা ও নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিজয়ী হবে।
লেখক : শরিয়াহ গভর্নেন্স ও আর্থিক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
কেকে/এজে