তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে মশাল প্রজ্বলন কর্মসূচি পালন করেছে রংপুর বিভাগের হাজার হাজার মানুষ। ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ১১টি পয়েন্টে ১০৫ কিলোমিটারজুড়ে একযোগে মশাল প্রজ্বলন করা হয়।
প্রশ্ন ওঠে কেন এ প্রকল্প এখনো বাস্তবায়িতের পথে হাঁটছে না? কাদের স্বার্থে এটি বারবার বিলম্বিত হচ্ছে? নদীপারের মানুষ কি শুধু প্রতিশ্রুতির শিকার হয়েই বেঁচে থাকবে? তিস্তা ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী। এটি ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
১৯৯৮ সালে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশ হিসেবে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মিত হওয়ার পর তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ পরিবর্তিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের অংশে তিস্তায় পানিপ্রবাহ থাকে না বললেই চলে। আবার বর্ষায় গজলডোবা ব্যারাজ থেকে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙন। এ অস্থিতিশীল প্রবাহ তিস্তাপারের মানুষকে প্রতিবছরই দুর্ভোগে ফেলছে। একদিকে ফসল ফলাতে পোহাতে হচ্ছে জটিলতা।
অন্যদিকে নদীভাঙনের ফলে হারাতে হচ্ছে ভূমি। উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে নানা সময়ে আলোচনা চললেও সেই আলোচনা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। নরেন্দ্র মোদিও বারবার তিস্তা চুক্তি নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত চুক্তি সম্পন্ন হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বে আনুমানিক ২৬০টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে এবং বিশ্বের ৪০ ভাগ লোক এ নদীগুলোর অববাহিকায় বসবাস করে। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ এবং যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। এমনকি খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ সালে সুমেরীয় শহর লাগাশ এবং উম্মার মধ্যে টাইগ্রিস নদীর পানি নিয়ে বিরোধ বাধলে তার নিষ্পত্তি হয় একটি চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দীর্ঘকালের মিত্রতা থাকলেও পানি চুক্তি আর হয় না।
ভারতের আধিপত্যশীল বন্ধুত্ব শুধু সুবিধা নিতেই অভ্যস্ত, দিতে নয় এমনকি ন্যায্য হিস্যাও দিতে অপরাগ ভারত। ফলে বাংলাদেশের তিস্তাপারের মানুষকে বাঁচাতে হাঁটতে হয় ভিন্ন পথে, নিতে হয় তিস্তা মহাপরিকল্পনা। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও তা এগোয় না। উত্তর বঙ্গের মানুষকে প্রতিশ্রুতির ডামাডোলে এভাবেই দীর্ঘকাল বঞ্চিত করে রেখেছে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ফলে এবার ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও’ বলে তিস্তাপারের মানুষজন জেগে উঠেছে।
তাদের দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ পরিকল্পনার কাজ শুরু হওয়ার কথা ২০২৬-এর জানুয়ারি মাসে, যার মূল লক্ষ্য তিস্তা অববাহিকার টেকসই উন্নয়ন করা। এ প্রকল্প বর্ষাকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীভাঙন রোধ এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে। উত্তর বঙ্গের মানুষের দাবি এটি দ্রুত কার্যকর করা হোক। আশ্বাসের বাণী তারা আর শুনতে চায় না। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। তিস্তা ও যমুনার সংযোগস্থলে তিস্তা নদী প্রশস্ততা মাত্র ৭০০ মিটার, অথচ উজানে এ নদীর প্রশস্ততা স্থানভেদে পাঁচ কিলোমিটার।
নদীর সংযোগস্থলটি অস্বাভাবিকভাবে সরু হওয়ার কারণেও উজানে বন্যার পানি সিঞ্চনে বাধাগ্রস্ত হয় এবং বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ে। খননের মাধ্যমে এ সংযোগস্থলের প্রশস্ততা আরো বাড়ানো জরুরি হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক নিয়ম উপেক্ষা করে নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখেই শুধু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে পানি ডিপ্লোম্যাসিকে সব ডিল্পোম্যাসির কেন্দ্রে রেখে সুসম্পর্ক গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করতে হবে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে যদি আন্তঃনদীর ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে এবং সেই লক্ষ্যেই জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ আইন (১৯৯৭) অনুস্বাক্ষর করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে তিস্তাপারের মানুষের ভোগান্তির পুনরাবৃত্তিই ঘটবে।
কেকে/ এমএস