সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই সরব বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনসহ ধর্মভিক্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলও পিআরের দাবিতে আন্দোলন করেছে। এ ছাড়া জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরও পিআরসহ তিন দাবিতে আন্দোলনে নামছে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো। এর মধ্যেই জামায়াতের পিআরের দাবি ‘পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়াকে লাইনচ্যুত করতে এবং জনগণের অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সংবিধান পুনর্গঠন প্রশ্নে জাতীয় আলোচনাকে ভিন্ন খাতে সরিয়ে দিতেই ইচ্ছাকৃতভাবে এর নকশা করা হয়েছে।’
অবশ্য নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহাবুব জুবায়ের বলেছেন, ‘দায়ত্বশীল জায়গা থেকে এমন বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে এনসিপির শীর্ষ নেতার এমন অভিযোগ রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ জামায়াত প্রশ্নে এনসিপি বরাবরই সহনশীল থেকেছে। এনসিপির অনেক নেতাই জামায়াতঘনিষ্ঠ বলে প্রচারণা আছে। এ ছাড়া দল গঠনের পর থেকে এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের বড় কোনো বিরোধ তৈরি হয়নি। যেখানে অন্যতম বৃহত্তর দল বিএনপির সঙ্গে এনসিপির নানা বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতেও বিএনপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই এনসিপির নেতারা বক্তব্য দেন। সেদিক থেকে জামায়াতের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্কই রয়েছে নবীন এ দলটির।
সেরকম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতের বিরুদ্ধে এনসিপির আহ্বায়কের মন্তব্য দেশের রাজনীতির নতুন মেরুকরণেরও চিহ্ন হতে পারে। কারণ জামায়াত অনেকদিন ধরেই পিআরের দাবিতে কথা বলে আসছে। কিন্তু এতদিন এ নিয়ে এনসিপির কোনো সমালোচনা ছিল না। কিন্তু জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পরই এ বিষয়ে জামায়াতের সমালোচনা এলো এনসিপির পক্ষ থেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদে জাময়াতের স্বাক্ষরের বিষয়টি এনসিপি ভালোভাবে নেয়নি। এনসিপি যখন আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা সনদে, স্বাক্ষর করবে না। জামায়াতও স্বাক্ষরের আগে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি। বরং সনদেও কিছু বিষয় নিয়ে এনসিপির মতো তাদেরও আপত্তি আছে। এ পরিস্থিতিতে এনসিপির ধারণা ছিল, জামায়াত জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না। কিন্তু সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন দেখা গেল, জামায়াত সেখানে স্বাক্ষর করে। এতে এনসিপি প্রতারিত বোধ করে থাকতে পারে।
গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে নাহিদ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর শুরু করা তথাকথিত ‘প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) আন্দোলন’ একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না।’ নাহিদ বলেন, ‘ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ওপর ভিত্তি করে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার মূল সংস্কারের দাবিকে একটি সাংবিধানিক সুরক্ষা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল। আমরা এ ধরনের মৌলিক সংস্কারগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং বিস্তৃত জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু জামায়াত ও তার মিত্ররা এই এজেন্ডা ছিনতাই করে এটিকে একটি প্রযুক্তিগত পিআর ইস্যুতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে এবং নিজেদের হীন স্বার্থ আদায়ে একে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের উদ্দেশ্য কখনোই সংস্কার ছিল না, ছিল কৌশলী অপব্যবহার।’
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী কখনোই সংস্কার আলোচনায় অংশ নেয়নি, জুলাই অভ্যুত্থানের আগেও না, পরেও না। তারা কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।’
তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে তাদের আকস্মিক সংস্কার-সমর্থন কোনো বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ছিল না, এটি ছিল কৌশলগত অনুপ্রবেশ সংস্কারবাদের মুখোশে রাজনৈতিক নাশকতা।’
নাহিদ আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এখন এই প্রতারণা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। তারা সত্যের প্রতি জেগে উঠেছে এবং আর কোনো ভুয়া সংস্কারবাদী বা ষড়যন্ত্রকারী শক্তির দ্বারা প্রতারিত হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ও এই দেশের সার্বভৌম জনগণ আর কখনো অসৎ, সুযোগসন্ধানী ও নৈতিকভাবে দেউলিয়া শক্তিগুলোকে তাদের ওপর শাসন করার অনুমতি দেবে না।’
কেকে/ এমএস