শাপলা প্রতীকের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শাপলা ছাড়া বিকল্প কোনো প্রতীক নিতে নারাজ দলটি। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নির্ধারিত তালিকায় না থাকায় এনসিপির কাক্সিক্ষত প্রতীকটি দেওয়া সম্ভব নয়। এনসিপি নিজেরা প্রতীক বাছাই করতে ব্যর্থ হলে ‘নিজস্ব পদ্ধতিতে’ তাদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক দল এনসিপি ভুল পথে হাঁটছে। জনসংশ্লিষ্ট ইস্যু বাদ দিয়ে দলটির রাজনীতি যেন আটকে আছে ‘শাপলা প্রতীকে’। তাদের অভিমত, অনেক সম্ভাবনা নিয়ে গঠিত দলটি জন-আকাক্সক্ষার রাজনীতি ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে তাদের কর্মসূচি কম। বরং ক্ষমতাকেন্দ্রিক তৎপরতাতেই সীমিত দলটির নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড। এতে দলটির জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, নতুন দল হিসেবে মাঠের রাজনীতিতেই এনসিপিতে মনোযোগী হতে হবে। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রচার করা উচিত। তার বদলে রাজধানীকেন্দ্রিক ক্ষমতাচর্চার যে প্রবণতা, তা দলটির জন্য ক্ষতিকর হবে। যেহেতু, ইসি থেকে বারবার বলা হচ্ছে, নির্ধারিত তালিকায় না থাকার কারণে শাপলা প্রতীক দেওয়া সম্ভব নয়, তাই এনসিপির উচিত তালিকা থেকে বিকল্প প্রতীক বাছাই করা এবং এ অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের অবসান ঘটানো। তাদের অভিমত, প্রতীক নয়, একটি রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনসংশ্লিষ্টতা।
এনসিপির জনবিচ্ছিন্নতার উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া ডাকসু নির্বাচনে তাদের সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবি। এ ছাড়া জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে প্যানেল দিতে পারেনি তারা। অথচ বিশ্ববিদ্যালগুলোই ছিল এনসিপির উত্থানের আঁতুড়ঘর। সেখানেই তাদের ব্যর্থতা চরমে। এর কারণ হিসেবে জনবিছিন্নতাই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতীক ইস্যুকে কেন্দ্র করে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও প্রকারান্তরে বিরোধে জড়াচ্ছে দলটি। যা অনাকাক্সিক্ষত। এ ইস্যুতে দলটির নেতাদের বক্তব্য কখনো কখনো রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত হয়ে পড়ছে। অন্য দলের প্রতীক বাতিল চাওয়ার মতো দাবি হঠকারিতা ছাড়া কিছু নয়।
নির্বাচন কমিশন বরাবরই বলেছে, তালিকায় না থাকায় এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দেওয়া সম্ভব নয়।
রোববারও নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার একই ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিক আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রতীকের তালিকায় ‘শাপলা’ না থাকায় এনসিপিকে সেই প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রতীক নির্ধারণ সংবিধান ও নির্বাচনি বিধিমালার আওতায় করা হয়। শাপলা প্রতীক সেই তালিকায় নেই, তাই তা বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগও নেই।’
এদিকে শাপলা ছাড়া বিকল্প প্রতীক পছন্দের শেষ দিনে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে এনসিপির নেতারা বলেছেন, কোনো ধরনের চাপিয়ে দেওয়া প্রতীক তারা নেবে না। শাপলা প্রতীকের বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরে ইসির চিঠির জবাব দিয়েছে দলটি। গতকাল সকালে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এনসিপির প্রতিনিধি দল।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে নির্বাচন কমিশন একটি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এ সিদ্ধান্তগুলো আসলে চাপিয়ে দেওয়া। প্রতীক বাছাইয়ে ইসির চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে না।’ বর্তমান ইসির প্রতীক বরাদ্দে কোনো নীতিমালা নেই মন্তব্য করে এ নেতা বলেন, ‘ইসির মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক অটোক্রেসি তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান দলগুলোকে যে মার্কা দেওয়া হয়েছে কোনো নীতিমালা নেই। মধ্যযুগীয় বর্বর শাসনব্যবস্থা যেমন দেখতাম রাজা যেমন ইচ্ছা করছে...। রাজা বাদশাহদের আচরণের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য রয়েছে। নির্বাচন আসলে রিমোট কন্ট্রোলটা এটা অন্য জায়গায়।’ বর্তমান ইসির সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার যোগ্যতা নেই বলে মন্তব্য করেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) বর্তমানে ‘জংলি কায়দায়’ পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী। তিনি সতর্ক করে বলেন, কমিশনাররা যদি নিজেদের মনমর্জি মতো ইসি চালান, তাহলে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এখন জংলি কায়দায় চলছে। আমরা চিঠি দিয়ে তাদের কাছে আইনি ব্যাখ্যা চেয়েছি। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন গণিমতের মাল হিসেবে বিভিন্ন পক্ষ ভাগাভাগি করে নিয়েছে।’
নির্ধারিত তালিকা থেকে প্রতীক পছন্দ করতে গত সপ্তাহে এনসিপিকে চিঠি পাঠানোর পর ইসি সচিব আখতার আহমেদ গত মঙ্গলবার বলেছিলেন, এনসিপি আগামী রোববারের মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা বিধির তফসিলে থাকা তালিকা থেকে প্রতীক বাছাই করে জানাতে ব্যর্থ হলে ইসি ‘নিজস্ব পদ্ধতিতে’ এনসিপিকে মার্কা বরাদ্দ দেবে।
এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর এনসিপিকে তফসিলে থাকা ৫০টি প্রতীক থেকে ৭ অক্টোবরের মধ্যে মার্কা বেছে নিতে চিঠি দেয় ইসি। নির্ধারিত সময়ে এনসিপি পছন্দের প্রতীক বাছাই না করে বিধি সংশোধন করে ফের শাপলা বরাদ্দের দাবি জানায়। কিন্তু ইসি কাউকে শাপলা প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থানে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ইসি এরই মধ্যে জানান, এনসিপি শাপলা দাবি করলেও প্রতীক তালিকায় না থাকায় তা বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। ইসির সিদ্ধান্ত একই।
কেকে/ এমএস