দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু। এর মধ্যে উত্তরের জেলাগুলোতে দেখা দিয়েছে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টও দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে ঘরে ঘরে সর্দিজ্বর ও এর কিছু উপসর্গ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নতুন করে ভাবাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, অক্টোবরে বাড়তে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এরই প্ররিপ্রেক্ষিতে জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। তবে এর মাঝে নতুন করে সর্দি-কাশিতে নতুন স্বাস্থ্যদুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
রেণুকা খাতুন একজন গৃহিণী। মাঝ বয়সি এ নারী কয়েকদিন আগে অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েন। রাতে হঠাৎ করে জ্বর আসে তার। সেইসঙ্গে সারা শরীরে অসম্ভব জ্বালাপোড়া বোধ করতে থাকেন তিনি। পরদিন ডাক্তার দেখান। কয়েকদিন ওষুধ খাওয়ার পর জ্বর ও জ্বালাপোড়া কমে যায়। এরপর একই সমস্যায় ভোগেন তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রাকিব আহমেদও সম্প্রতি জ্বরে পড়েন। এ সময় পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন তিনি, যেন পা বেঁকে যাচ্ছে। কখনো অবশ অনুভব করেন। এভাবে তিন দিন অসুস্থতায় ভোগেন রাকিব। সাধারণ জ্বরের ওষুধ খেয়েই পরে সুস্থ হয়ে যান।
স্কুল শিক্ষিকা সুপ্তা বিশ্বাসও জ্বরে পড়েন সম্প্রতি। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড কাশি। বুকে কফ জমে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে এক সপ্তাহ ধরে ওষুধ খাচ্ছেন। জ্বর কমে এলেও কাশি পুরোপুরি সারেনি। তবে সারাক্ষণ দুর্বল বোধ করেন তিনি।
রাজধানীর একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমন। গত শুক্রবার তার জ্বর আসে। এক রাতের ব্যবধানে থার্মোমিটারের পারদে ছাড়ায় ১০২ থেকে ১০৪-এর ঘর। তার চিকিৎসা চলাকালীনই জ্বরে আক্রান্ত হয় ছোট ভাই রিমন। এরপর ঘরের আরো কয়েকজন জ্বরে আক্রান্ত হন। তবে সবার মধ্যে একটি উপসর্গ কম ছিল, তা হলো হাত বা পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, যেন শরীর বেঁকে আসছে। ডাক্তারের কাছে গেলে সাধারণ ‘ফ্লু’ বললেও নিবিড় পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখলে সঙ্গে সঙ্গে যেন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সে বিষয়েও সতর্কতা দেন চিকিৎসক। কিন্তু ফ্লু না কোনো নতুন ভাইরাস, তা নিয়ে খোদ ডাক্তারও দ্বিধায় রয়েছেন।
বর্তমানে ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। চলতি মাসের শেষেই শীত নামতে শুরু করবে। ফলে কখনো গরম, কখনো খানিকটা শীত অনুভূত হচ্ছে। এমন অবস্থায় হাসপাতালগুলোতে মৌসুমি রোগী বাড়ছে প্রতিদিন। ডায়রিয়া, হাঁপানিসহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরাই বেশি ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। এর মধ্যে নতুন করে ঘরে ঘরে মানুষের জ্বরে আক্রান্ত হওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
চার কারণে এমন উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে খোলা কাগজকে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এরকম উপসর্গ নিয়ে আমাদের কাছে রোগীরা আসছেন। এখানে দুই তিনটা ব্যাপার আছে। এ জাতীয় ব্যথার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে চিকনগুনিয়া। এ ছাড়া আমরা কিছু ভাইরাল ফ্লু পাচ্ছি, সেক্ষেত্রেও এমন হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, এটা ডায়াগনস্টিক ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। কারণ সাধারণ পরীক্ষায় অধিকাংশ সময় এটা ধরা পড়ছে না। এটা সঠিক পরীক্ষার জন্য অনেক টাকা লাগে। যা অধিকাংশ মানুষ এফোর্ট করতে পারেন না। তাই এ-জাতীয় জ্বর ও উপসর্গের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমতো ভাবব চিকনগুনিয়া, এরপর ফ্লু/ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় ভাইরাস। এ ছাড়া আরেকটা ব্যাপার আমরা মনে করছি। ডেঙ্গুর ভাইরাসের ধরনে পরিবর্তন আসছে। সে পরিবর্তনের কারণেও এ ব্যাপারটা ঘটতে পারে।’
ডা. লেনিন চৌধুরী আরো বলেন, ‘মূলত আমাদের দেশে চার ধরনের ভাইরাসজাতীয় জ্বর হচ্ছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু।’ তিনি বলেন, ‘এ ভাইরাসগুলোর আচার-আচরণ নিয়ে যে গবেষণা, তা আমাদের দেশে একেবারেই হচ্ছে না। ভাইরাস কিন্তু রূপান্তরিত হয়। যদি গবেষণা হতো তাহলে এ রূপান্তরের ধরন কেমন, এর লক্ষণগুলো কেমন এবং এ রূপান্তরিত ভাইরাস দ্বারা যে রোগগুলো তৈরি হচ্ছে, তার লক্ষণগুলো কেমন তা জানা যাচ্ছে না। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের অনুমাননির্ভর বা পর্যবেক্ষণভিত্তিক আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি।’
বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নানাবিধ আক্রমণে জনসাধারণের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যেটা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কারণ এতে জাতীয় শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ফলে সরকারের অবশ্যই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।’ এক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যদি কারো এরকম জ্বর আসে, তাকে পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। বয়স অনুসারে তিন থেকে চার লিটার পানি খেতে হবে। তাজা ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। এর সঙ্গে বিশ্রামে থাকতে হবে। শুধু প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খাবে। জ্বরের এক-দুই দিনের মধ্যে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’
হাসপাতালে বাড়ছে রোগী : এদিকে ঠান্ডা রোগীর সঙ্গে সঙ্গে জ্বরের রোগীরও ভিড় বাড়ছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগীর পরিমাণ।
তবে সবচেয়ে বেশি রোগী ভিড় করছে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিশুদের ভর্তি করাতে নিয়ে আসছেন অভিভাবকরা।
জ্বর হলেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করানোর পরামর্শ : জ্বর হলেই নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরীক্ষায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ শনাক্ত হলে অনতিবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার অনুরোধও করা হয়েছে। গত রোববার স্বাস্থ্য অধিপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক মঈনুল আহসান গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এ অনুরোধ করেছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেরিতে হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে উপস্থিত হওয়ায় জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় সব জ্বরের রোগীকে জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অত্যন্ত সতর্ক ও তৎপর উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট, স্যালাইন ও ওষুধ মজুত আছে। তবে মৃত্যু কমানোর জন্য একইসঙ্গে দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্তকরণ, গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া এবং মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কার্যকর হওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর পাচ্ছি, লোকজন জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি ডেঙ্গু, করোনা, নাকি অন্য কোনো ভাইরাস, তা গবেষণা না হওয়া পর্যন্ত রোগীর পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে। জ্বরে আক্রান্ত হলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ও করোনা উভয় টেস্ট করিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। অন্যথায় যে কোনো ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।’
কেকে/ এমএস