বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ছয়টি বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে জানিয়ে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, ব্যাংকিং খাতের সম্ভাব্য দুর্বলতা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে বিলম্ব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিঘ্ন, প্রত্যাশার তুলনায় ধীরগতিতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং জ্বালানি সরবরাহে সীমাবদ্ধতা দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে সীমিত করতে পারে এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির গতিকে মন্থর করতে পারে।
তবে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা বেড়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সাময়িক হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর চূড়ান্ত হিসাবে তার আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’-এ এমন পূর্বাভাস দিয়েছে। ঢাকায় বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটের বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন সংস্থার সিনিয়র অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত খান।
এর আগে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতির ওপর হালনাগাদ প্রতিবদেন ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট’-এর ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রানজিসকা ওহসরজে। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর জঁ পেসমে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সিনিয়র এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স কর্মকর্তা মেহরিন আহমেদ মাহমুদ।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট অনুযায়ী, মূলত মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং বেসরকারি ভোগব্যয়ের জোরদার হওয়ার কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগ তেমন গতিশীল হবে না। এদিকে, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা অব্যাহত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় থাকবে, যার কারণে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী থাকার আশা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমদানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাব পুনরায় ঘাটতিতে যেতে পারে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ফলে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা সম্ভব হবে। যদিও ভর্তুকি প্রদানের হার সংস্কারের কারণে ধীরে ধীরে কমছে, সুদ পরিশোধের সঙ্গে মিলিয়ে এটি মোট চলতি ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি দখল করবে। সরকারের ঋণ আগামী ২০২৬-২৭ অর্থবছরের মধ্যে জিডিপির প্রায় ৪১.৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ঋণ সংকটের ঝুঁকি আগে ‘নিম্ন’ পর্যায় থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ‘মধ্যম’ পর্যায়ে এসেছে।
অর্থনীতি স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, কিন্তু এটিকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ ও ভুটানের বিশ্বব্যাংক বিভাগের পরিচালক জিন পেসমে বলেন, ‘একটি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পথ এবং আরও উন্নত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন সাহসী সংস্কার এবং দ্রুত বাস্তবায়ন যাতে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা বৃদ্ধি, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস, নগরায়ণ পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা।’
এলডিসি থেকে উত্তরণ : বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ করলেও তাৎক্ষণিকভাবে রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। কারণ, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০২৯ সাল পর্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক সুবিধা বজায় রাখবে। এলডিসি উত্তরণ ব্যবসায় সম্প্রসারণ, বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুযোগ তৈরি করবে। নির্বাচনপরবর্তী নীতির স্বচ্ছতা ও দ্রুত সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে জিডিপি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃজন ও দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুত সম্ভব হবে।
ব্যাংক খাত : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ শনাক্তকরণ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে মার্চ ২০২৫ নাগাদ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ২৪.১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় ৭.৯ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে তারল্য সহায়তা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শাসনব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা জোরদার করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করার জন্য আইনি কাঠামোর সংশোধনী।
বাহ্যিক খাত : বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, প্রবাসী আয় বছরওয়ারি ২৬.৮ শতাংশ এবং রপ্তানি আয় ৮.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক, কৃষিপণ্য ও জুতা শিল্পের ভালো পারফরম্যান্সের ফল। অন্যদিকে, আমদানি ৪.৩ শতাংশ বেড়েছে, মূলত চাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের কারণে, যদিও মূলধনী পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। নিট প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ২০.১ শতাংশ বেড়ে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা মোট জিডিপির মাত্র ০.৪ শতাংশ। এর ফলে সামগ্রিক পরিশোধ ভারসাম্য আগের বছরের ৪.৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থেকে ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে নমনীয়, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার গ্রহণের পর থেকে টাকার বিনিময় হার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে।
কর-জিডিপি অনুপাত ও বাজেট : রাজস্ব আয় কিছুটা বাড়লেও করের জিডিপি অনুপাত ৭.৪ শতাংশ থেকে ৬.৮ শতাংশে নেমেছে। চলতি ব্যয় জিডিপির ৯.২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা প্রধানত জ্বালানি ও কৃষি খাতে ভর্তুকি এবং উচ্চ সুদ পরিশোধের কারণে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, সরকারের পদক্ষেপে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য কর নীতি ও প্রশাসনের পৃথকীকরণ, কর ব্যয় ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য অনলাইন ট্যাক্স ফাইলিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস