আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা-সংশয়ের মেঘ যেন কাটছেই না। দিন যত গড়াচ্ছে ততই তা ঘনীভূত হচ্ছে। এতদিন এ সংশয় রাজনৈতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা বিস্তৃত হয়ে পড়েছে সরকারপ্রধান পর্যন্ত। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক মন্তব্যে নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে নতুন কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
তার বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্ন। অনেকেই মনে করছেন, পূর্ব ঘোষিত ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে সরকারপ্রধানের বক্তব্যে। এটাকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ।
নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় গত সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনের ফাঁকে জিটিও নামে একটি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন ড. ইউনূস। প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনি বলছেন মানুষ এখনই নির্বাচন চায়, কিন্তু মানুষ এটাও বলছে আমাদের আরো ৫ বছর, ১০ বছর, এমনকি ৫০ বছর থাকতে হবে।’
তার দাবি, দেশের মানুষ এখন নির্বাচন নয়, আগে কাঠামোগত সংস্কার, বিচার এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন চায়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, কার্যক্রম স্থগিত হওয়ায় তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারবে না। তারা একটি দল হিসেবে বৈধ। কিন্তু তাদের কার্যক্রম কিছু সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের কার্যক্রম সচল করা হতে পারে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। কঠোর সমালোচনা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রশ্ন তুলেছেন রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা নিয়েও। এ ছাড়া ‘আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বৈধ’ ড. ইউনূসের দেওয়া এ বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বানও জানানো হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ফেসবুক পোস্টে এ আহ্বান জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। পোস্টে হান্নান মাসউদ লেখেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রত্যাহার করুন। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আপস নয়। আওয়ামী লীগের ব্যানার সন্ত্রাসী ব্যানার, এ ব্যানারে কোনো রাজনীতি চব্বিশের প্রজন্ম মেনে নেবে না। দেশকে আবার অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবেন না। অবিলম্বে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করুন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক মন্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তিনি মনে করেন দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী চায়, তিনি ও তার অন্তর্বর্তী সরকার আরো ৫, ১০, এমনকি ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকুক। ডা. জাহেদের প্রশ্ন কে এই জনগণ? কারা এ ধরনের কথা বলছে? তিনি বলেন, বাংলাদেশকে চালাতে হলে রাজনৈতিক দলই লাগবে। ভালো হোক কিংবা খারাপ হোক। উন্নতি করতে চাইলে রাজনৈতিক দল দিয়েই করতে হবে। এর বাইরে কোনো ‘সুশীল সরকার’ দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। তার মতে, ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্য ২০০৭ সালের সেই আলোচিত সময়ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে, যখন রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন করে ‘সুশাসনের নামে’ একটি অনির্বাচিত শক্তি ক্ষমতায় এসেছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে কবি-লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও রাষ্ট্র চালানো এক জিনিস নয়। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের আয়োজনে ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, আপনি সংবিধান রক্ষা করবেন। সংবিধানে কোথায় উপদেষ্টা সরকার আছে। কোন অনুচ্ছেদে আছে। আপনি অবৈধ সরকার। আমি প্রথম দিন থেকে বলছি, আপনি অবৈধ সরকার। তবে অবৈধ সরকার বলার মানে এই না যে আপনাকে আমরা চাই না। এটা মানে হচ্ছে, আপনার প্রথম কাজ আপনার নিজের বৈধতা নিশ্চিত করা। আপনার নিজের বৈধতা নিশ্চিত করবার একটা মাত্র পথ আছে সেটা হল গণঅভ্যুত্থান, কারণ গণঅভ্যুত্থান সংবিধান মেনে ঘটেনি।
অন্যদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করে তার আলোকে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে দ্বিতীয় ধাপে ১২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। গতকাল মঙ্গলবার দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পৃথক সংবাদ সম্মেলন ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
তবে এ কর্মসূচিকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন পিআর বিরোধী দলগুলো। দেশের মানুষকে ‘নির্বাচনমুখী’ দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনে যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা হবে। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করার জন্য কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করছে এবং সেটা দৃশ্যমান হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
ভোটে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সমালোচনা করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি হচ্ছে, একটা পারমানেন্ট রেস্টলেসনেস পদ্ধতি। যার মধ্য দিয়ে দেশে এবং বিভিন্ন দেশে এটা দেখা গেছে যে, একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে সব সময়ের জন্য। কোনো স্থায়ী সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় না সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায়, কখনো মেজরিটির ভিত্তিতে সরকার গঠন করা সম্ভব হয় না, একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট থাকে, অস্থির অবস্থা থাকে।
বাংলাদেশের মানুষ পিআর পদ্ধতির একটা জরিপে দেখলাম যে, ৫৬% মানুষ পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে। কোনো একটা জরিপে দেখলাম, কোনো একটা দল বলছে যে, ৭০% পিআর চায়। যদি ৫৬% লোক পিআর পদ্ধতি নাই বুঝে তাহলে ৭০% লোক কীভাবে পিআর পদ্ধতি চায় সেটা আমাদের বুঝে আসে না।
তিনি বলেন, আমরা পিআর মানে মনে করি পাবলিক রিলেশন, আমরা পিআর মানে মনে করি, জনসংযোগ। সবাই জনসংযোগে আছে সেই পিআর এ আমরা বিশ্বাস করি। যারা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন মানে পারমানেন্ট রেস্টলেসনেস প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা সফল হবে না।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, নির্বাচন পেছানোর কোনো চক্রান্তে এনসিপি যুক্ত নয়। বরং এনসিপি চায় দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যেন আয়োজন করা হয়। গত সোমবার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিভিন্ন দুর্গামন্দির পরিদর্শনের পর হাফিজাবাদ ইউনিয়নের হুদুপাড়া দুর্গামন্দির প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
সারজিস আলম বলেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন কিছু বিদেশি শক্তি নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এনসিপি সব সময় বলে আসছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিচার ও সংস্কার প্রয়োজন। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে শঙ্কা কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরাজিত, পলাতক ও পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি মোকাবিলাই আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তাদের নেতাকর্মী ও সাপোর্টাররাও আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টায় পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন পক্ষকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে? জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পুলিশ থানা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে এক বছরে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসা একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমরা চাচ্ছি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা অর্জন করতে। আমাদের বিশ্বাস পারব। তিনি বলেন, আমি তো কোনো শক্তির কথা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। যারা পরাজিত, ফ্যাসিস্ট তারাই আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তাদের নেতাকর্মী ও সাপোর্টাররাও আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
কেকে/ এমএস