# বাড়তি প্রায় সব পণ্যের দাম
# চালের দামও ‘রেড জোনে’
# হিসাব মিলছে না নিম্ন আয়ের মানুষের
দেশের বাজারে লাগামহীন নিত্যপণ্যে স্বস্তি ফিরছেই না। রোজকার খাবারের মৌলিক উপাদান মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, শাক-সবজি- সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো এখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতেই হিমসিম খাচ্ছে। মাসের শেষে সংসার চালাতে ঋণ নিতে হচ্ছে বহু পরিবারকে। ব্যয় কাটছাঁট করেও মিলছে না স্বস্তি। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জীবনধারণ এখন এক দুঃসাধ্য লড়াইয়ের নাম।
নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কখনো কোনো পণ্যের দাম ‘সামান্য’ কমলেও সপ্তাহের ব্যবধানে তা ফের বাড়ছে। এ অবস্থায় বাজারে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। টিসিবির বাজারদর বিশ্লেষণ বলছে, গত দুই মাসেই পেঁয়াজ, ডিম, ডাল ও সবজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
অন্যদিকে বিক্রেতারাও বলছে, টানা বৃষ্টির কারণে কৃষকের খেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, ফলে সরবরাহ কমেছে। মিরপুর কাজিপাড়া বাজারের সবজি বিক্রেতা রকিব উদ্দিন জানান, পাইকারি বাজারেই আগের চেয়ে দ্বিগুণ দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। ফলে খুচরায়ও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। দাম বাড়ায় ক্রেতারা সবজি কেনা কমিয়ে দিয়েছে, এতে আমাদেরও লোকসান হচ্ছে।
চালের দাম ‘রেড জোনে’ :
দেশের চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ধানের বাম্পার ফলন, সন্তোষজনক সরবরাহ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমেছে। সারসহ কৃষি উপকরণের দামও নিম্নমুখী। মূল্য কমার এমন অনুকূল পরিবেশেও দেশের বাজারে বেপরোয়া গতিতে বাড়ছে চালের দাম। অজুহাত দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিকবার বন্যা, টানা বর্ষণসহ নানা বিষয়। দেশ-বিদেশের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চালের দাম এখন কমার কথা। কিন্তু দাম তো কমছেই না, উলটো বাড়ছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে ‘রেড জোন’ বা লাল তালিকায় চলে গেছে চাল। সাম্প্রতিক সময়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (চলতি বছরের আলোচিত মাসের সঙ্গে গত বছরের একই মাসের তুলনায়) প্রতি মাসে গড়ে চালের দাম বাড়ছে ১০ শতাংশের বেশি। গত ১২ মাসের হিসাবের মধ্যে ৯ মাসই চালের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বাকি ৩ মাস দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের কম।
এদিকে চালের দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে ভোক্তার খরচ বাড়ছে। দেশের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের বেশির ভাগ ভোক্তার প্রধান খাদ্য চাল। তাদের জীবনযাত্রার মোট খরচের মধ্যে ৪৪ দশমিক ২০ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ খরচ করে চাল কিনতে। একক পণ্য হিসাবে চাল কেনায় ভোক্তা বেশি অর্থ ব্যয় করেন। এ কারণে চালের দাম বাড়লে ভোক্তার জীবনযাত্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এই তিন সরকারি সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে চালের দামের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণের জন্য বিভিন্ন বাজার থেকে নিত্যপণ্যের দামের যেসব তথ্য সংগ্রহ করে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির উত্তাপের নকশা তৈরি করেছে। ওই নকশায় কোনো পণ্যের দাম কোনো মাসে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি বাড়লে তা লাল তালিকায় বা রেড জোনে ফেলা হয়। ৮ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে বাড়লে হালকা লালে, ৬ শতাংশের বেশি থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে বাড়লে লাল-সবুজের মিশ্রণের অঞ্চলে, ৪ শতাংশের বেশি থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে বাড়লে সবুজাভাব অঞ্চলে, ২ শতাংশের বেশি থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে বাড়লে হালকা সবুজ ও শূন্য থেকে ২ শতাংশের মধ্যে বাড়লে সবুজ রংয়ে ফেলা হয়। কোনো পণ্যের দাম কমলেও তাকে গাঢ় সবুজ রংয়ের মধ্যে ফেলা হয়।
এদিকে টিসিবির প্রতিদিনের বাজারদরের তথ্য থেকে মাঝারি মানের চালের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তথ্য সংগ্রহ করে তার গড় করে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ৪ মাস চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশে চাল রফতানিতে নতুন নিয়ম ভারতের :
ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল রফতানি নিয়ন্ত্রণে রফতানির ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম জারি করেছে ভারত সরকার। নতুন এই নিয়মের ফলে চাল আমদানির গতি কমার সঙ্গে সঙ্গে খরচ বাড়ায় দেশে দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা।
ভারত থেকে নন-বাসমতি চাল রফতানিতে সে দেশের কৃষি ও খাদ্যপণ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (অচঊউঅ) সঙ্গে চুক্তি নিবন্ধন সাপেক্ষে তা রফতানি করতে হবে। গত বুধবার ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা এই সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করেছে। গতকাল থেকেই নতুন এই নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে বলে আমদানিকারকরা জানিয়েছেন। বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সরবরাহ ঘাটতি নয়, বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও তদারকির অভাবও দায়ী। বাজার তদারকি না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে রাজধানীর বাজারগুলোতে সাধারণ ক্রেতারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়তে দেখা গেছে। এক ডজন ডিম কিনতে খরচ হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা, মসুর ডাল কেজি ১৮০ টাকা পর্যন্ত। করলা, বরবটি, পটোল, ঢেঁড়স আগে তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যেত, সেগুলোও এখন ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে সস্তা সবজি পেঁপেও কেজিতে ৪০ টাকার কম পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি বেড়েছে দেশি পেঁয়াজ, দেশি রসুন, আমদানি করা আদা ও কাঁচামরিচের। এ ছাড়া মাছ ও মাংসের উচ্চমূল্য দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষের। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর রায়সাহেববাজার, নয়াবাজার, হাতিরপুল বাজার, নিউ মার্কেট কাঁচাবাজার, মিরপুর কাজিপাড়া, কারওয়ান বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করা সংগঠন ‘ভোক্তা’র নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল মনে করেন, ভোক্তারা এখন এতটাই সহনশীল হয়ে গেছে যে, এই অস্বাভাবিক দামকে ভাগ্যের ফের মনে করছে। অথচ সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিয়মিত বাজারে হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, এই সংকট নিরসনে বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা জরুরি। পাইকারি পর্যায়ে মনোপলি ভাঙা, খাদ্য আমদানিতে শুল্ক কমানো এবং কৃষিপণ্যের সরাসরি বিপণন চ্যানেল শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা না হলে খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই থাকবে।
কেকে/ এমএ