পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক বিতর্কের ঝড় ওঠে সে সময়। ‘দিনের ভোট রাতে’ হওয়ার অভিযোগ ওঠে, যা দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় তোলে। ওই বিতর্কিত নির্বাচন পরিচালনা করেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। নির্বাচনের পর থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাকে ‘রাতের ভোটের সিইসি’ বলে কটাক্ষ করতে থাকে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন নানা বিতর্কে জড়ায়, এমনকি কমিশনের সদস্যদের মধ্যেও ছিল মতবিরোধ ও কাদা ছোড়াছুড়ি।
তবে এ নিয়ে এতদিন কোনো দায় স্বীকার করেননি নূরুল হুদা। সম্প্রতি বিএনপির করা এক মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। এরপর আদালতে জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সাবেক এ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমানের খাস কামরায় জবানবন্দি গ্রহণ শুরু হয়।
আদালতে জবানবন্দির বিষয়ে পুলিশের আবেদনে বলা হয়, সাবেক সিইসি একেএম নূরুল হুদা ৪ দিনের জিজ্ঞাসাবাদে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম ও দিনের ভোট রাতে করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার অপরাধের বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে নিজেই সম্মতি দিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক সৈয়দ সাজেদুর রহমানের সই করা আবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৮ সালে সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় শেখ হাসিনা নূরুল হুদার মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরো বলেছেন যে, তৎকালীন অবৈধ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাসহ নির্বাচন কমিশনাররা পূর্ণ সহায়তা করে অবৈধভাবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত করার পরিকল্পনা করে। নূরুল হুদাসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিতদের দ্বারা দিনের ভোট রাতে করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখে।
নূরুল হুদা ৩০ ডিসেম্বর সকালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের এবং বিএনপির ৬ প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে গেজেট প্রকাশ করে বলেও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।
আবেদনে বলা হয়, কে এম নূরুল হুদা স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম ও দিনের ভোট রাতে করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখার অপরাধের বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে নিজেই সম্মতি দিয়েছেন।
গত ২২ জুন উত্তরার নিজ বাসভবনে একদল জনতার হামলার শিকার হন কে এম নুরুল হুদা। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। পরদিন আদালত তাকে ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠান।
এর আগে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নূরুল হুদা, কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাছির উদ্দীনের কাছে মামলার আবেদনের অনুলিপি পৌঁছে দেন।
বিএনপির অভিযোগ, ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালে একাদশ এবং ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের নেতাসমর্থকদের মিথ্যা মামলা, অপহরণ ও হুমকি দিয়ে টার্গেট করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য অনেককে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হয়েছে। বিএনপির ভাষ্য, এ মামলার আসামিরা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নামও রয়েছে।
মামলার আসামিদের মধ্যে আরো রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, জাবেদ পাটোয়ারী ও শহিদুল হক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার বেনজীর আহমেদ, স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম। একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদফতরের (ডিজিএফআই) সাবেক প্রধানকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিএনপি বলেছে, এ ব্যক্তিরা ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় কারচুপির জন্য দায়ী।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে ক্ষমতায় বসতে শেখ হাসিনা দুহাতে অর্থ ছিটান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ, আমলা, ডিসি, এসপিদের দেওয়া হয় এ অর্থ। দলীয় ক্যাডারদের মাঝেও অর্থ বিলানো হয়। সরকারি হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ পুলিশকে আগাম অর্থ বরাদ্দ দেন ২৭২ কোটি টাকা। অ্যাডভান্স পাওয়া টাকার মধ্যে ৬৩ কোটি ২২ হাজার টাকা। র্যাবকে ১০ কোটি ২০ লাখ ২৯ হাজার। কোস্টগার্ডকে ১ কোটি ৫৬ লাখ। বিজিবিকে ৩৩ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। আনসার ও ভিডিপিকে দেওয়া হয় ১৬৩ কোটি ৮১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
ওই নির্বাচনে একেকটি কেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৬ জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি নিরাপত্তা কর্মীকে প্রাপ্য অর্থের দ্বিগুণ, তিনগুণ করে দেওয়া হয়। বাস্তবে জালিয়াতি ও প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনে মানুষকে ভোট দিতে হয়নি। ভোট গ্রহণের আগের রাতে দলীয় কর্মী, পুলিশ এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যালট বাক্স ভরে রাখেন। প্রহসনের ওই নির্বাচনের যাবতীয় খরচ কার্যত ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং আত্মসাৎ।
নূরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির মাধ্যমে সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব ছাড়েন। তার মেয়াদে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন ছাড়াও তার কয়েকটি মন্তব্য সমালোচনার জন্ম দেয়, যেমন- ‘যুক্তরাষ্ট্র ৫ দিনে ভোট গুনে, আমরা ৫ মিনিটে’ অথবা ‘দিনের ভোট রাতে হওয়া নিয়ে আমি মোটেও বিব্রত নই’।
কেকে/এআর